বিএনএ, সাতকানিয়া(চট্টগ্রাম) : চট্টগ্রামের সাতকানিয়া- লোহাগাড়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় সরকারি বন দখল করে প্রাকৃতিক হ্রদের উপর প্রভাবশালীরা বাধ দিয়ে বানিয়েছিলেন ন্যাচারাল পার্ক নামক লেক। কৃত্রিম লেকের বাঁধ কেটে দেয়ায় শীতের মৌসুমে আকস্মিক পানির স্রোতে সাতকানিয়ার সোনাকানিয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সোনাকানিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দীন দাবি করেন,বাঁধের পানিতে ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি সম্পুর্ন ও সাড়ে ৩ শতাধিক বাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়েছে। সবজি ক্ষেত,পুকুরের মাছ, রাস্তাঘাট,বাজারসহ ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
অবৈধ বিধায়। লেক পাড়ের ওপর দেওয়া বাঁধ কাটা হয়েছে গত শনিবার (৩ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ৯ টায়। গত শনিবার বেলা সাড়ে তিনটায় বাঁধ কাটার কাজ শুরু হয়ে আর শেষ হয় রাত সাড়ে ৯ টায়।
সাতকানিয়া- লোহাগাড়ার সোনাকানিয়া ও বড়হাতিয়া বনের প্রায় আড়াই হাজার একর বনভূমি ডুবিয়ে কৃত্রিম হ্রদ তৈরি করেছিল স্থানীয় প্রভাবশালীরা। সেই হ্রদে মাছ চাষ করা হয়েছিল। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। হ্রদটি তৈরি করা হয়েছে বনের সোনাইছড়ি ছড়ায় বাঁধ দিয়ে। বাঁধের দৈর্ঘ্য ২০০ ফুটের মতো। প্রস্থ ২০ ফুট ও উচ্চতা ১০০ ফুট।
বন বিভাগের দাবি, তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়া শুরু করলেও সদ্য সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য (চট্টগ্রাম-১৫) আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভীর কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।
তিন বছর আগে বাঁধ করা হলেও এত দিন ধরে তা অপসারণ করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।অনেকদিন পর গত শনিবার এ বাঁধ কেটে দেওয়ার পদক্ষেপ নেন বন বিভাগ।
বাঁধ কাটার কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন বন বিভাগের চট্টগ্রাম সদরের সহকারী বন সংরক্ষক মারুফ হোসেন এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক দেলোয়ার হোসেন। এ ছাড়া বন বিভাগের প্রায় ৬০ জন বনকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
সহকারী বন সংরক্ষক মারুফ হোসেন ও দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার নির্দেশে বনের জায়গায় দেওয়া বাঁধ অপসারণ শুরু করেছেন তাঁরা। যত সময় লাগুক আজকের মধ্যে এই অবৈধ বাঁধ পুরোপুরি কেটে দেওয়া হবে। এরপর এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেবেন। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলমান।
বাঁধ কাটার কাজ করেছেন অন্তত ৫০-৬০ জন শ্রমিক। তাঁরা কোদাল দিয়ে বাঁধের মাঝ বরাবর অংশ কেটে পানিপ্রবাহের পথ তৈরি করছেন। মাটি নরম করার জন্য শ্যালো মেশিন ব্যবহার করা হয়েছে। আর বাঁধ এলাকায় নির্মিত টিনের ঘর ভেঙে দিয়েছেন ক্ষুব্ধ কৃষকেরা।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত কৃষকরা বলেন, গত শনিবার ছিল তাঁদের অনেক বড় খুশির দিন। কেননা এই বাঁধের কারণে তাঁদের কৃষিজমি নষ্ট হয়েছে। পানি না থাকায় চাষাবাদ করতে পারেননি। বনে অবৈধভাবে বাঁধ দেওয়ায় তাঁরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন বাঁধ কেটে দেওয়া হচ্ছে। আগের মতো পানি পাওয়া যাবে। তাতে চাষাবাদ করতে পারবেন।
বন বিভাগের দাবী, হ্রদ তৈরির কারণে গামারি, সেগুন, চিকরাশি, অর্জুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় প্রায় পাঁচ লাখ গাছ মারা গেছে। ডুবে যাওয়া জায়গার মধ্যে বন্য হাতির চলাচলের পথ ছিল। খ্যাঁকশিয়াল, শজারু, বন্য শূকর, বনমোরগ, ময়ূর, গুইসাপ, অজগরসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী এবং নানা প্রজাতির প্রাণী বাস করত সেখানে।
কৃষকেরা বলছেন, বাঁধ দেওয়ার ফলে ছড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এতে লোহাগাড়া ও সাতকানিয়ার ৪ হাজার ২৫৫ একর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কৃষকেরা শুরু থেকেই সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করলেও প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি।
বনের আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা বলেন, হ্রদটিতে শুষ্ক মৌসুমে পানির গভীরতা থাকে ৪৫ ফুটের মতো। তবে বর্ষায় গভীরতা বেড়ে প্রায় ৬০ ফুট পর্যন্ত দাঁড়ায়। সেখানে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা হয়। হ্রদে নিয়মিত টিকিট কেনার বিনিময়ে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার সুযোগ দেওয়া হয়। একেকজনের কাছ থেকে নেওয়া হয় তিন থেকে চার হাজার টাকা। পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেওয়ার জন্য দুটি নৌকা রয়েছে।
স্থানীয় সূত্র বলছে, হ্রদ তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা মূলত সেখানে একটি বড় পর্যটনকেন্দ্র করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন।
এদিকে হঠাৎ করে কোন প্রকার ঘোষণা ছাড়া ওই বাধ কেটে দেয়ায় শীতের রাতে পানিতে ভেসে গেছে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা, সম্পুর্ন ভেঙে পড়েছে ৬০ টি মাটির ঘর।
পানির প্রচণ্ড তোড়ে সাতকানিয়ার সোনাকানিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র মির্জাখীল বাংলাবাজার পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে যায়।
পানির প্রচণ্ড তোড়ে ১টি স্লুইসগেট ভেঙে গেছে। এমন আকস্মিক পানির স্রোতে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ভেসে গেছে সদ্য লাগানো ধানের চারা।
এলাকাবাসী জানায়, রাতে লোহাগাড়ার বড়হাতিয়ার পর পশ্চিমের পাহাড় থেকে বাধের পানি পার্শ্ববর্তী সাতকানিয়ার সাইরতলী, তাঁতীপাড়া ডুবে যায়। এরপর একে একে কুতুবপাড়া, মঙ্গলচাঁদ পাড়া পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। এই পানি একসময় এসে পৌঁছায় সোনাকানিয়ার মির্জাখীল গ্রামে।মির্জাখীল বাংলাবাজার দোকানের প্রচুর মালামাল ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ব্যবসায়ীদের এতে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাবাজারের ভাসমান দোকানিদের পণ্যসামগ্রী মুহূর্তেই ভেসে যায় পানির তোড়ে।
পানির স্রোতে উপজেলার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের সাইরতলী পাড়ার ইউসুফ আলী, মোস্তাক, খুলু মিয়া,আহমদ মিয়া,নুর আলম, নুর মোহাম্মদ ছাফর,মোজাফ্ফর আহমদ আবদুল কাদের,আবদুল হামিদ, মো. সমশু,আবদুল আজিজ, মো.মিন্টু, মোছাম্মৎ জামিনা,ওয়াহেদ আলী, মোবারক হোসেন ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়াহাব মিয়া, শফিকুল ইসলাম ও মো.তারেকের ঘরসহ অর্ধশতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি সম্পূর্ন ভেঙে যায়।
ফসলি জমির আলু, মরিচ, শসা ক্ষেতসহ শীতকালীন সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন পুকুরে চাষ করা মাছও পানির প্রবল তোড়ে ভেসে গেছে।আকস্মিক পানির তোড়ে গবাদিপশু নিয়েও অনেকেই ভোগান্তিতে পড়ে যান। কেউ কেউ শুকনো জায়গায় পশুসহ ঠাঁই নিয়েছেন।রাতে অনেক লোকের হাঁস-মুরগি পানিতে ভেসে গেছে। মির্জাখীল বাংলাবাজার সংলগ্ন ব্রিকফিল্ডে কাঁচা ইটসহ সদ্য আগুন দেওয়া ইটভাটারও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আলহাজ মো. মহিউদ্দীন, আইয়ুব জমিদার ও সৈয়দ হোসেন জানান, বাঁধের পানির কারনে দেড় কোটি টাকার স্লুইসগেট,কাঁচা বাড়িঘর,১২ একর ফসলি জমির খেতসহ পুকুরের মাছ ভেসে গিয়ে অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে।
সোনাকানিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দীন জানান,বাঁধের কারণে ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি সম্পুর্ন ও সাড়ে ৩ শতাধিক বাড়ি আংশিক ক্ষতি হয়েছে। সবজি ক্ষেত,পুকুরের মাছ, রাস্তাঘাট,বাজারসহ ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস জানান,বাঁধের পানিতে স্লুইসগেট, অর্ধশতাধিক বাড়িঘর,রাস্তাঘাট,সবজি ক্ষেত,মাছ,বোরো ক্ষেত,বাজারসহ প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান,উক্ত পানিতে আনুমানিক ১৮ লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বিএনএ, এসএমএনকে, এসজিএন /এইচমুন্নী