ড. মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী
বিএনএ ডেস্ক: জীবনের প্রধান এবং প্রথম লক্ষ্য হোক আমাদের সন্তানদের ভালো মানুষ করা। আমরা চাইলে আমাদের সন্তানদের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি করতে পারবো না, একটু ভালো চেষ্টা করলে ভালো মানুষ করতে পারি। শরীরিক সৌন্দয্যের মধ্যে কোন গর্ব নেই, কারণ এটিতে নিজের অর্জন নেই, বংশ মর্যাদা গৌরব করার কিছু নেই, কারণ এটি অর্জনের বিষয় নয়। গর্বের বিষয় হলো নিজের অর্জিত যোগ্যতা ও চরিত্রবান হওয়া। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সনদ প্রদানের কারখানা নয়, মূল্যবোধ জাগ্রত করার প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত । নৈতিক শিক্ষা নেই বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ধর্ষণ, মাদক ও যৌন হয়রানিতে লিপ্ত হয়। শিক্ষকরাও যৌন হয়রানিতে পিছিয়ে নেই। শিক্ষকের নিকট আলো না থাকলে তারা সমাজে আলো জ্বালাবে কী করে। সমাজে আমরা বড় লোক খুঁজছি, বড় মানুষ নয়। শিক্ষকরা বড় মানুষ না হলে, ছাত্রদের বড় মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে কী ভাবে। দিন দিন অনৈতিকতা দেখতে দেখতে আমাদের নৈতিকতার অনুভূতিগুলো অকেজো-অচল হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি না এই নৈতিকতার অনুভূতিগুলো সচল করবো কী ভাবে।
ঈমাম গাযযালী (রাহ:) বলেছেন, ‘যখন দেখবে শিক্ষক আর চিকিৎসক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে, তখন ধরে নিও সমাজ অধঃপতনের চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে’। আজ শিক্ষক আর চিকিৎসকদের দুর্নীতি দেখলে বুঝাযায় আমরা কোন সমাজে বসবাস করছি। প্রতিযোগিতা ও গতিশীল বিশ্বে সবাই দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে চায়। আজকের প্রতিযোগিতায় সত্যের চেয়ে মিথ্যার চর্চা অনেক বেশি। বড় হওয়ার স্বপ্ন ভালো কিন্তু সত্যকে বিসর্জন দিয়ে নয়।
সত্তরের অধিক বয়স। অভাবের কারণে রিক্সা চালান। তাঁর রিক্সায় এক যাত্রীর ফেলে যাওয়া লক্ষ টাকার বাণ্ডিল মালিককে খুঁজে ফেরত দেন। অবাক করার মত বিষয় হলো, এই গরিব রিক্সাওয়ালা বিনিময়ে দেওয়া কোন পুরস্কার গ্রহণ করেননি। যখন সমাজের প্রচুর তথাকথিত শিল্পপতি ব্যাংক লুট করে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করে, একজন সরকারি কর্মকর্তার ড্রাইভার যখন অবৈধভাবে শতকোটি টাকার মালিক হয়, এমন সময় একজন নির্লোভ রিক্সাচালকের চরিত্রের চেয়ে তাদের চরিত্র কত নিম্নে তা বিস্ময়ে ভাবি।
টাঙ্গাইলের অজপাড়া গাঁয়েব পঞ্চম শ্রেণির মাদ্রাসার ছাত্রী মারিয়া আকতার মাদ্রাসার যাওয়ার পথে একলক্ষ টাকা কুড়িয়ে পায়। তার জন্য একলক্ষ অনেক টাকা। মারিয়া লোভ না করে এই টাকার প্রকৃত মালিককে খুঁজে হাতে তুলে দেন। মারিয়ার নিকট জানতে চাইলো, এই সততার শিক্ষা কোথায় শিখেছো ? সে জানালো, অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ না করার শিক্ষা তার মা ও মাদ্রাসার আদর্শের শিক্ষক হতে অর্জন করেছে। মারিয়ার মা-বাবা বড় কোন শিক্ষিত মানুষ নন, কিন্তু নীতি নৈতিকতার মাপকাঠিতে বড় এক মানুষ।
মানুষ হিসেবে কে বড়? লুটেরা ধর্ণাঢ্য ব্যক্তি, না গরিব রিক্সাচালক, না নির্লোভ মাদ্রাসার ছাত্রী? মারিয়াও রিক্সাচালকের অভাব ছিল কিন্তু অভাববোধ ছিল না। লুটেরাদের অভাব নেই, কিন্তু তাদের রয়েছে প্রচণ্ড অভাববোধ। অভাববোধ মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট করে পশুতে পরিণত করে। এখনো আমাদের সমাজটা যতটুকু টিকে আছে লুটেরা, অর্থ আত্মসাৎকারী, অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতিবাজদের জন্য নয়, মারিয়া ও সৎ রিক্সাওয়ালাদের কারণে। মারিয়া ও রিক্সাচালক এদেশের বড় বড় ডিগ্রীধারী ‘হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল’দের শিক্ষা দিয়ে গেলেন মানবতা ও মনুষ্যত্বের। যা এদেশের অমানুষরা কখনো গ্রহণ করবে না। ভালো আর আলোকে ধারণ করার ক্ষমতা লাগে। সে ক্ষমতা মহান আল্লাহর দান।
বাসদের সাবেক আহ্বায়ক বামপন্থী সৎ ত্যাগী নেতা খালেকুজ্জামান ভূঁইয়ার কাছে টকশোর সঞ্চালক প্রশ্ন করেছিলেন, আপনাদের ভালো রাজনীতির ভালো কথাগুলো জনগণ গ্রহণ করে আপনাদের ভোট দেয় না কেন?
উত্তরে তিনি হেসে জানালেন, ‘জনগণ আমাদের রেসপেক্ট করে এক্সসেপ্ট করে না’। এই দুটি শব্দ দ্বারা আমাদের চরিত্রের অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলেন।
আমরা মহামনীষীদের স্মরণ করি কিন্তু অনুসরণ করি না। স্মরণের মাঝে অনুসরণ না করলে সে স্মরণ কোন কাজে আসবে না। সে স্মরণ দ্বারা ব্যক্তি ও সমাজের কোন উপকার নেই। দুনিয়ার সেরা সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে ডিগ্রী অর্জন করে কী লাভ হবে, মনটা যদি অশিক্ষিত থাকে। প্রকৃত সাধনা, শিক্ষা কি? Individual mind (ব্যক্তিমন) কে Cosmic Mind (বিশাল মন) এ পরিণত করার নামই প্রকৃত সাধনা এবং প্রকৃত শিক্ষা। চোখ বুজে জপ করলেন, ধ্যান করলেন, নামাজ, রোজা, হজ করলেন, কিন্তু মনটা বড় করতে পারলেন না, এটি তো বড় সার্থকতা নয়। সংকীর্ণ মন নিয়ে বিশাল কাজ করা যায় না। দেশের রাজধানী ঢাকা। মানুষের শরীরের রাজধানীর নাম ‘কলব’। এই কলব শব্দটি পবিত্র কোরআনে ১৩২ স্থানে আছে।
মানুষের মনের পরিবর্তনই প্রকৃত পরিবর্তন। দুনিয়াতে বহু ধরনের চেতনা আছে। সব চেতনার উৎস হলো ‘চিত্ত’ (মন)। মনীষীরা বলেন, ‘চিত্ত হতে চেতনা, চেতনা হতে কর্ম’। আমার চিত্ত (মন) পরিশুদ্ধ না হলে চেতনা পরিশুদ্ধ হবে না, চেতনা পরিশুদ্ধ না হলে কর্ম পরিশুদ্ধ হবে না, কর্ম পরিশুদ্ধ না হলে ব্যক্তি পরিশুদ্ধ হবে না, ব্যক্তি পরিশুদ্ধ না হলে সমাজ-দেশ পরিশুদ্ধ করা যাবে না।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘মহান আল্লাহ পাক তোমাদের শরীর আর চেহারার দিকে দেখেন না, তিনি দেখেন কলবের দিকে। (মুসলিম শরীফ)
আমরা রাষ্ট্রক্ষমতা বদলাতে চাই, অনেকবার বদলিয়েছি, একদল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে বিরক্ত লাগে, তাই বদলাই। কিন্তু নিজেকে বদলাতে আমরা রাজি নই, সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য আগে নিজেকে বদলাতে হবে। দুনিয়াব্যাপী ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে, হবে। মনের উন্নতি না হলে, মানসিক পরিবর্তন করতে না পারলে, এসব উন্নতি চোখের সুখ, উন্নতি নামের টিউমার (যা বড় হবে কিন্তু রোগ বাড়বে)।
তাই শহরের অপরিকল্পিত উন্নয়নকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘পৃথিবীর এলার্জি’। এসব উন্নতিকে গুরুত্ব না দিয়ে মনের পরিবর্তনে গুরুত্ব দিতে হবে।
বিএনএনিউজ/ আরএস