বিএনএ, বিশ্বডেস্ক : গবেষকরা বলছেন, এক পরীক্ষার অংশ হিসাবে ব্রাজিলের একটি শহরের প্রায় সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে পুরো ডোজ টিকা দেবার পর সেই শহরে কোভিড-১৯এ মৃত্যুর হার ৯৫ শতাংশ কমে গেছে। সেরানা শহরে বাসিন্দার সংখ্যা ৪৫০০০, যাদের চীনে তৈরি করোনাভ্যাক টিকা দেয়া হয়েছে।
গবেষক দলটি বলছে, করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি কমে যাওয়ার কারণে যাদের টিকা হয়নি, তারাও সুরক্ষার আওতায় চলে এসেছে।
এই পরীক্ষার ফলাফল থেকে বোঝা যাচ্ছে, জনগোষ্ঠীর শতকরা ৭৫ ভাগকে পুরো ডোজ টিকা দিতে পারলে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।করোনা মহামারি ব্রাজিলে এক বিপর্যয়কর রূপ নিয়েছে। দেশটিতে এপর্যন্ত কোভিড-১৯এ মারা গেছে প্রায় চার লাখ ৬৩,০০০ মানুষ।
যথেষ্ট টিকার ডোজ না থাকায় ব্রাজিল টিকাদান কর্মসূচি চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, টিকাদান চলছে খুবই ধীরগতিতে। দৈনন্দিন মৃত্যুর সংখ্যা এবং শনাক্তের গড় হারও খুবই বেশি। সমন্বিত পদক্ষেপের অভাবে সংক্রমণ কমানোর প্রচেষ্টাও সফল হচ্ছে না।
ব্রাজিলের সাও পাওলো রাজ্যের দক্ষিণ পূর্বের শহর সেরানাতে এই পরীক্ষা চালানো হয় ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে। পরীক্ষা চালায় ইনস্টিটিউটো বুতানতান, যারা চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেক কোম্পানি উদ্ভাবিত টিকা করোনাভ্যাক তৈরি করছে ব্রাজিলে।
কীভাবে চালানো হয় পরীক্ষা?
শহরের বাসিন্দাদের ভাগ করা হয় চারটি এলাকার ভিত্তিতে। করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি বা জীবাণুর পরিমাণ কোন্ এলাকায় কমছে সেটা নির্ধারণ করতে এই এলাকা ভাগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
গবেষক দলটি বলছে, ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ৭৫%কে দুই ডোজ টিকা দেবার পর তিনটি এলাকায় করোনার উপস্থিতি ব্যাপক মাত্রায় কমে গেছে বলে তারা দেখতে পান।
যখন প্রাপ্তবয়স্কদের ৯৫ শতাংশকে পুরো ডোজ টিকা দেয়া হয়ে যায়, তখন যে ফলাফল দেখা যায়:
** মৃত্যুহার কমেছে ৯৫%
** হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা কমেছে ৮৬%
** উপসর্গ আছে এমন রোগী শনাক্তের হার কমেছে ৮০%
বুতানতান সংস্থার গবেষণা পরিচালক রিকার্ডো পালাসিও বলেছেন, এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যাটা হল ৭৫%।
”গবেষণার ফলাফল থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা বেরিয়ে এসেছে সেটা হল গোটা জনগোষ্ঠীকে টিকা না দিয়েও মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব,” তিনি বলেন।
পালাসিও আরও বলেন, শিশু এবং কিশোরদের মধ্যেও সংক্রমণের হার কমেছে। তাদের টিকা দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, এর থেকে এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে যে স্কুল আবার খোলার জন্য শিশুদের টিকা দেবার প্রয়োজন নেই।
পালাসিও বলছেন, করোনাভাইরাসের যে ভ্যারিয়েন্ট প্রথমে পি.১ নামে পরিচিত ছিল, যার এখন নতুন পরিচয় গামা নামে, সেই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও এই টিকা কার্যকর। ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলে অ্যামাজন নদীর তীরের মানাউস শহরে প্রথম এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয় এবং তখন থেকে ব্রাজিল ভ্যারিয়েন্ট নামে পরিচিত হয়ে ওঠা কোভিডের এই ধরনটিকেই দেশ জুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বাড়ার জন্য দায়ী করা হয়।
সেরানা সাও পাওলো থেকে ৩১৫ কিলোমিটার দূরে এবং এর চারপাশের শহরগুলো উর্ধ্বমুখী সংক্রমণ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
সেরানা থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার দূরে রিবেইরাও প্রেতো নামে এক শহরে লকডাউন জারি হয়েছে, যে শহরের জনসংখ্যা সাত লাখ ১০ হাজার।
চীনা ভ্যাকসিন
বলা হচ্ছে, এই পরীক্ষার ফলাফল চীনা টিকা করোনাভ্যাক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষের আস্থা বাড়াবে। কয়েক ডজন উন্নয়নশীল দেশ চীনের এই টিকা ব্যবহার করছে।
এ বছর ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া এবং তুরস্কে এই টিকার ক্লিনিকাল ট্রায়ালে কার্যকারিতার হার ৫০% থেকে ৯০%এর মাঝামাঝি আসায় এই টিকা নিয়ে কিছু বিতর্ক তৈরি হয়।
করোনাভ্যাক একটি নিষ্ক্রিয় ভ্যাকসিন। এই ধরনের টিকায় মৃত ভাইরাসের কণা শরীরে প্রবেশ করানো হয় যাতে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা এই ভাইরাসকে চিনে রাখে, কিন্তু এই ভাইরাস থেকে যিনি টিকা নিচ্ছেন তার ওই রোগে গুরুতরভাবে সংক্রমিত হবার আশংকা থাকে না।
সেরানাতে চালানো এই পরীক্ষা পৃথিবীর আরও কোন দেশে হয়নি। এটাই প্রথম এধরনের পরীক্ষা বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা।
এই ভ্যাকসিন থেকে গুরুতর কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া যায়নি এবং টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেবার ১৪ দিন পর পর্যন্ত যারা টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে কোভিড-জনিত কোন রোগে কারও মৃত্যু হয়নি, বলে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে।
এখন ব্রাজিলের আরেকটি শহর বতুসাতুতে একই ধরনের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। ওই শহরের জনসংখ্যা এক লাখ ৪৮ হাজার। গবেষকরা সেখানে ব্যবহার করছেন অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রজেনেকার ভ্যাকসিন, যেটি ব্রাজিলে উৎপাদন করছে স্থানীয় কোম্পানি ফিয়োক্রুজ ইনস্টিটিউট।
আমেরিকার পর বিশ্বে কোভিডে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে ব্রাজিলে। শনাক্ত রোগীর সংখ্যার হিসাবেও ব্রাজিল বিশ্বে তিন নম্বরে। সেখানে করোনা শনাক্তর সংখ্যা এক কোটি ৬৫ লক্ষ।
দেশটির প্রেসিডেন্ট জেয়ার বোলসোনারো এই মহামারি মোকাবেলা কীভাবে করেছেন এবং দেশটিতে ভ্যাকসিন কর্মসূচির ধীর গতি নিয়ে ব্রাজিলের সেনেট একটি তদন্ত চালাচ্ছে। (বিবিসি)
বিএনএনিউজ/এইচ.এম।