বিএনএ ডেস্ক : বাংলাদেশের ওপারে মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলছে। লড়াইয়ে তীব্রতা এতটা বেশি যে রাতদিন সেখান থেকে বিকট শব্দ ভেসে আসছে। শুধু কী শব্দ? কখনো কখনো উড়ে আসছে গোলা। বাংলাদেশ সীমান্তে বসবাসকারি মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। একই সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা দেখা যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আধা সামরিক বাহিনী বিজিবিকে সর্তক ও বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে।
এই অবস্থায় বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা নড়েচড়ে বসেছে। নিজ জন্মভূমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে কক্সবাজারের উখিয়া আশ্রয়শিবিরে সমাবেশ করেছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। ১ ফেব্রুয়ারি উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে ওই সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশ থেকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে প্রত্যাবাসন ইস্যুতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপ করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানানো হয়। অন্যথায় একজোট হয়ে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেন রোহিঙ্গারা।
লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে জড়ো হন রোহিঙ্গারা। তাঁরা প্রায় সবাই সাদা শার্ট ও লুঙ্গি পরা ছিলেন। সমাবেশে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবির থেকে রোহিঙ্গা হেড মাঝি, সাবমাঝি, ধর্মীয় নেতা ও নারীরা অংশ নেন। এ সময় ‘অনেক হয়েছে আর নয়; এবার স্বদেশে ফিরতে চাই’ বলে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেয়।
রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরওএফডিএমএনআরসির প্রতিষ্ঠাতা মো. কামাল হোসাইন বলেন, ‘সমাবেশে মা-বাবা, ভাই-বোন যাঁরা এসেছেন, তাঁদের অধিকার যদি যুবকেরা কাঁধে নেন, তাহলে ১ বছরের মধ্যে ইনশা আল্লাহ, আমাদের দেশে আমরা ফিরে যেতে পারব।’
রোহিঙ্গা ছলিম উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের দেশ আছে। মিয়ানমারের আরাকান আমাদের দেশ। আমরা দেশে ফিরে যেতে চাই।’
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কোন সফল পদক্ষেপ আসেনি। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে এ পর্যন্ত যতগুলো বড় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার প্রতিটিতেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে চীন।
এখন চীন এই সমস্যার সমাধান করতে ভূমিকা রাখতে পারবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এজন্য যেসব কঠোর পদক্ষেপ ও প্রভাব মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বেইজিংকে নিতে হবে তা চীন চাইবে কিনা সেটিই একটি বড় প্রশ্ন।
তাদের মতে, ছোট ছোট পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে অল্প কিছু রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর মতো পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এ ধরণের পদক্ষেপের মাধ্যমে চীন আসলে মিয়ানমারের একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে মাত্র।
চীনের মধ্যস্থতায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে তিনটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে, যেগুলোর কোনটিই সফল হয়নি। এছাড়া রোহিঙ্গারা তাদের নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের বিষয়টি ফায়সালা না করে ফিরতে রাজি ছিল না। তবে এবার তাদের ফিরে যাওয়ার একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এজন্য চীনকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। কেননা জান্তা সরকার ও বিদ্রোহী উভয়ের সঙ্গে সুর্স্পক রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, চীন রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে কতটা আন্তরিকতা দেখাবে?
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল। মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের মধ্যস্থতাতেই সেই চুক্তি হয়েছিল। তখন চীনের তরফ থেকে বারবার বলা হয়েছে, মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিবর্তে দুই দেশের আলোচনার ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা উচিত।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেছেন যে, চীনের মধ্যস্থতায় এখনো পর্যন্ত কোন চুক্তি হয়নি। তিনি বলেন, ২০১৭-১৮ সালে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে যে চুক্তিটি হয়েছিল সেটি পুরোপুরি দ্বিপক্ষীয় একটি বিষয় ছিল। মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করেই বাংলাদেশ সেই চুক্তিটি করেছিল। সেখানে কারো কোন চাপ বা মধ্যস্থতা ছিল না।
২০১৮ সালের ১৫ই নভেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি আর বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি। এরপর ২০১৯ সালে আগস্টে চীনের তরফ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর আরেকটি উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় যেতে চায়নি।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমার নিয়ে এপর্যন্ত জাতিসংঘে বিশেষ করে এর নিরাপত্তা পরিষদে যত প্রস্তাব উঠেছে তার প্রায় সবগুলোই ঠেকিয়ে দিয়েছে মিয়ানমারের দুই বন্ধু দেশ রাশিয়া ও চীন।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার নিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে দেশটির রাজনৈতিক নেত্রী অং সান সুচিসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির আহ্বানের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া হয়।
ওই প্রস্তাবটিতে ১২টি দেশ ভোট দেয় এবং বিপক্ষে কোন দেশ ভোট দেয়নি। এই ভোটাভুটিতে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র রাশিয়া ও চীন ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। ভোট দেয়নি ভারতও।
সবশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে একটি পাইলট প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা শুরু করে চীন। এপ্রিলে এ নিয়ে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সাথে আলোচনা করতে ঢাকা সফর করেন চীনের বিশেষ দূত দেং সি জুন।
সে ধারাবাহিকতায় এপ্রিলেই কুনমিংয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশ নেন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এর আওতায় একটি পাইলট প্রকল্পের অধীনে ১১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার প্রস্তাব তোলা হয়। একটি রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গিয়ে সেখানকার বসবাসের ব্যবস্থাপনা ঘুরে দেখে আসার পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেনি।
পরের মাসে অর্থাৎ মে-তে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সাথে দেখা করে। এই পর্যন্ত গত এক বছরে এ বিষয়ে আর কোন অগ্রগতি নেই।
২০১৭ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখার জন্য বিশ্বের প্রায় সব দেশকেই আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, ভারত, চীন। তবে সেসময় বাংলাদেশের এই আহ্বানে চীন ছাড়া অন্য কোন দেশ সাড়া দেয়নি।
তবে চীন যেভাবে এখন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছানুযায়ী পাইলট প্রকল্প করে তাদের ভাবমূর্তির উন্নয়নে যেভাবে সমাধান চাইছে, তাতে এই সংকটের টেকসই সমাধান আসবে না। চীনকে মিয়ানমার সরকার ও বিদ্রোহী উভয়ের ওপর চাপ দিতে হবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে যেসব অংশীদার রয়েছে তাদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
বিএনএ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী, ওজি/ হাসনা