বিএনএ, ঢাকা : ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জের ধরে ১৫ বছর ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা আওয়ামী লীগের পতন হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমান বাহিনীর হেলিকাপ্টারে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ফলশ্রুতিতে ছাত্ররাই বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ কর্তা হয়ে ওঠে। তাদের আহবানে সুদূর প্যারিস থেকে ছুটে আসেন নোবেল বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। গ্রহণ করেন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধানের দায়িত্ব। ছাত্রদের একটি অংশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অংশ হয়ে যায়। এভাবে ২৪ পরবর্তী রাজনীতি হয়ে ওঠেছে তারণ্য নির্ভর।

গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র সমন্বয়করাই পরবর্তীতে গঠন করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। যেমনটি দেখা গেছে, স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ সালে। আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে সিরাজুল আলম খান ‘দাদা ভাই’-এর নেতৃত্বে মূলধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি হতাশ হয়ে গঠন করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। নতুন এই দলটি হয়ে ওঠে তারণ্যের প্রতীক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু তাদের কৌশলগত ভুলের কারণে পরবর্তীতে সেই রাজনৈতিক স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি জাসদ। নেতৃত্বের কোন্দল ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাসদ বেশ কয়েকটি ব্র্যাকেটে বন্দী হয়ে পড়ে।
প্রায় ৫০ বছর পর, বাংলাদেশে আবারও ছাত্রদের নেতৃত্বে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—একটি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। জাসদ ও এনসিপি’র মধ্যে একটি ঐতিহাসিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়—১৯৭০-এর দশকে যেমন জাসদ গঠিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের চিন্তা ও আদর্শ থেকে, তেমনি এনসিপিও উঠে এসেছে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও আদর্শগত অনুসন্ধান থেকে।
এনসিপির তরুণ নেতারাও সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে একই রকম গভীরভাবে ভাবছেন। তবে এখানেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি উঠে আসে, তাঁরা কি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন, নাকি জাসদের পথেই হাঁটছেন? কারণ, শুধু উচ্চ আদর্শ বা রাজনৈতিক আবেগ দিয়ে নয়, একটি আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করে সঠিক কৌশল, ধৈর্য এবং জনগণের বাস্তব চাহিদা বোঝার ওপর।
জাসদের লক্ষ্য ছিল ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’।১৯৭২ সালে জাসদ যখন সমাজবদলের কথা বলেছিল, তখন তারা মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর শহরের কিছু বুদ্ধিজীবীর চিন্তার জগতে সীমাবদ্ধ ছিল। তারা চেয়েছিল শ্রেণিবিহীন সমাজ গড়তে, রাষ্ট্রব্যবস্থা একেবারে পাল্টে ফেলতে।
মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর জাসদের উত্থান ও পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি বইয়ে বলেন, জাসদ একরকম নিজেদের তাত্ত্বিক জগতে আটকে পড়েছিল, ফলে তারা জনতার আবেগ ও বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। বদরুদ্দীন উমরের মতে, জাসদের শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনের অভাব ছিল, যা তাদের গণভিত্তি গড়ে তুলতে বাধা সৃষ্টি করেছে।
সদ্য গঠিত এনসিপি বলছে তাদের লক্ষ্য ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’। তারা চায় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, সংবিধান পাল্টাতে এবং নতুন ধরনের সরকার গঠন করতে। কিন্তু গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, পোশাক কারখানার শ্রমিক কিংবা শহরের রিকশাওয়ালারা এসব বুঝবেন কীভাবে? তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা তো অন্য জায়গায়—চালের দাম, কাজের নিশ্চয়তা, চিকিৎসা, বিচার পাওয়ার আশা। যাঁরা নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠনের কথা বলছেন, তাঁরা কি এই মানুষের ভাষায় কথা বলছেন?
এনসিপি কি সেই প্রয়োজনীয় ‘হোমওয়ার্ক’ শেষ করতে পেরেছে, যা জাসদ ৫০ বছর আগে করতে পারেনি? রাজনৈতিক চিন্তাবিদ গ্রামসি তাঁর প্রিজন নোটবুকস বইয়ে বলেছিলেন, কোনো ‘তাত্ত্বিক ধারণা’ জনগণের জীবনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে তা কাগজে থাকবে, বাস্তবে নয়। এ ছাড়া সমাজবিজ্ঞানী পিয়েরে বুর্দিয়ো বলেছিলেন, সমাজের বাস্তবতা না বুঝে যারা কেবল বড় বড় কথা বলে, তারা একধরনের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতি করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, গণজাগরণ বা প্রতিরোধ আন্দোলনের উৎস শুধু শহর নয়, বরং বহু সময়েই তা উঠে এসেছে গ্রাম থেকে। ঔপনিবেশিক আমলে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা কিংবা তেভাগা আন্দোলন—সবই শুরু হয়েছিল গ্রামের শোষিত কৃষক ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের হাত ধরে।
কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা প্রবণতা দেখা যায়—আন্দোলনের ভাষা, দৃষ্টি ও নেতৃত্ব ক্রমেই শহরকেন্দ্রিক। অথচ বাংলাদেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে বসবাস করে। তাদের জীবনের সমস্যা, চাহিদা, চিন্তা—সবকিছুই শহরের মানুষের চিন্তার জগৎ থেকে অনেক ভিন্ন।
জাসদের রাজনীতি ছিল শহর কেন্দ্রিক। শহরের সভা-সেমিনার আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যস্ত ছিল। ৫০ বছর পর ঠিক তেমনটি দেখা যাচ্ছে এনসিপি’র কর্মকান্ডে। সমসাময়িক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে তারা ডাক দেয় শাহবাগ কিংবা রাজুতে সমাবেশে আসার! অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পৃষ্টপোষকতা থাকার কারণে গত ৮ মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টি বেশ কিছু দাবি পূরণ করতে সর্মথ হয়। কিন্তু সেকেন্ড রিপাবলিক, গণপরিষদ নির্বাচন, সংবিধান বাতিল, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা, রাষ্ট্রপতি ও সেনা প্রধানের অপসারণে মতো ভারি ভারি দাবির কোনটিই আদায় করতে পারেনি। এমন বাস্তবাতায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন!
জাসদ ও এনসিপির মধ্যে মূল পার্থক্য তাদের আন্দোলনের কৌশলে। জাসদের কৌশল ছিল সশস্ত্র সংগ্রাম। জাসদ সশস্ত্র বিপ্লবের পথে হেঁটেছিল—পুলিশ স্টেশন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছিল এবং ১৯৭৫ সালে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিল, যাতে বহু সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। এমনকি ১৯৭৪ সালের ২৫ মে জাসদপন্থী গণবাহিনী ভারতীয় হাইকমিশনের এক কর্মকর্তাকে অপহরণের চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন নিহত হন। এসব ঘটনায় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও অনাস্থা তৈরি হয়।
এই অস্থিরতার ভেতরে মানুষ শান্তির জন্য নতুন নেতৃত্ব খুঁজতে থাকে। আওয়ামী লীগ ও জাসদের হঠকারিতায় বিরক্ত জনগণ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি ও জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে সামনে নিয়ে আসে। জিয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং স্থিতিশীলতার বার্তা দেন, যা তখনকার প্রেক্ষাপটে ছিল এক বড় পলিটিক্যাল নেরেটিভ।
আশার কথা এনসিপি জাসদের মতো সহিংস পথে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও সংস্কারের পথে হাঁটছে। তবে
এনসিপি সরকারের পৃষ্টপোষকতায় ইতিমধ্যে নানা অনিয়ম দূর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে।
দলের মধ্যে দেখা দিয়েছে বির্তক। এনসিপি ফ্যাসিবাদ নির্মূলের শ্লোগান দিয়ে প্রকারান্তরে নিজেরাই ফ্যাসিবাদকে লালন করছেন এমন অভিযোগ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এসব ঘটনা রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের উত্তপ্ত পরিস্থিতির স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠছে, বর্তমান তরুণ নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কী দায়িত্বশীল ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারছেন? নাকি তাঁরাও জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলছেন? যা ঘটেছিল ১৯৭২ সালে তারণ্যের উচ্ছ্বাস নিয়ে জন্ম নেয়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর ক্ষেত্রে !
বিএনএনিউজ/সৈয়দ সাকিব/এইচ.এম।