বিএনএ, ডেস্ক : বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করা ডলারের পতন ঘটছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বিশ্ববাজারে ডলারের যে পতন হয়েছে, তা ১৯৭৩ সালের পর সবচেয়ে বড় ধস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান ১০ শতাংশের বেশি কমেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রাসী, অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নীতি বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাচ্ছেন ডলারে। আর তার ফলস্বরুপ ডলারের দাম কমছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুল্ক আরোপ, এককেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি, ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণ এবং মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা—সবকিছু মিলিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আস্থার ঘাটতি তৈরি করেছে। এতে শেয়ারবাজার ও বন্ডবাজার সাময়িক ইতিবাচক সাড়া দিলেও ডলারের মান পড়েছে ধারাবাহিকভাবে।
যদিও ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পরপর ডলার ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বিনিয়োগকারীদের ধারণা ছিল, ট্রাম্প ব্যবসাবান্ধব ও প্রবৃদ্ধিমুখী। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করা হলে বিপুল সুবিধা দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন। ফলে ধারণা করা হয়েছিল, ট্রাম্প বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারবেন এবং পরিণতিতে ডলারের চাহিদা বাড়বে।
কিন্তু সেই আশা স্থায়ী হয়নি। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় অর্থাৎ ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের সময় ডলার সূচক সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছার পরই পড়তে শুরু করে। নতুন প্রশাসন ব্যবসাবান্ধব হবে, সেই আশা দূর হয়ে শুরু হয় উচ্চ মূল্যস্ফীতির আতঙ্ক, উচ্চ সুদহারের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব আর অর্থনীতি ও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা।
অনেক দিন ধরেই বৈশ্বিক বিনিয়োগের নিরাপদ গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে ট্রাম্পের হুটহাট সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বদল বিনিয়োগকারীদের বিকল্প কিছু খোঁজার পথে ঠেলে দিয়েছে।
গত ২ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প একেবারেই অপ্রত্যাশিত উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন; যে বিষয়টি অর্থনীতিবিদ, বিনিয়োগকারী কিংবা বিশ্লেষক—কেউই অনুমান করতে পারেননি। ফলে শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে বন্ডের বাজার ও ডলার—সব ক্ষেত্রেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এই বছরের মতো ডলারের পতনের নজির কমই আছে। ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবার এমন পতনের মুখে পড়ে ডলার। সে বছর বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলো ডলারের সঙ্গে মুদ্রা বিনিময়ের হার বেঁধে রাখার পদ্ধতি থেকে সরে এসেছিল। সেটি ঘটেছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের স্বর্ণমানের সঙ্গে ডলারের সম্পর্ক ছিন্ন করার দুই বছর পর।
এদিকে ডলারের এই দুর্বলতার কারণে শেয়ারবাজারে চাঙা ভাবের পুরো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিনিয়োগকারীদের মুনাফায় প্রভাব পড়ছে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক যখন ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে, তখন ইউরোয় হিসাব করলে সেই মুনাফা দাঁড়াচ্ছে মাত্র ১৫ শতাংশ—সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে ১০ শতাংশ নিচে।
এখন অনেক মার্কিন বিনিয়োগকারী দেশের বাহিরের দিকে ঝুঁকছেন। ইউরোপের শেয়ারবাজার সূচক ইউরোস্টক্স ৬০০ একই সময়ে ১৫ শতাংশ বাড়লেও ডলারে রূপান্তর করলে তা ২৩ শতাংশে উঠেছে। বড় বড় পেনশন তহবিল থেকে শুরু করে ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাহিরে আরও ভালো বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজছে।
বেশিরভাগ বিশ্লেষকই বলছেন, “ডলারের পতন” শুধু একটি মুদ্রার মানহ্রাস নয় — এটি একটি সংকেত, বিশ্ব আর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত। ট্রাম্পের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক নীতি, ফেডের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া, আন্তর্জাতিক ব্যবসায় ও বিনিয়োগের ধারা বদল — সবই একত্রে এই পতনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
শামীমা চৌধুরী শাম্মী