বিএনএ, ঢাকা : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) হলে সহপাঠী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা হত্যার শিকার আবরার ফাহাদের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বুয়েটে চান্স পেয়েছেন। বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) রাতে বুয়েটের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফলাফলে, আবরার ফাইয়াজ ৪৫০তম হয়ে যন্ত্রকৌশল বিভাগে চান্স পেয়েছে।
বড় ভাইকে হারানো আবরার ফাইয়াজ বুয়েটে চান্স পেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি আবেগময় স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার আবেগঘন স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
‘আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর ইচ্ছায় বুয়েটে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তির সুযোগ লাভ করতে পেরেছি। আসলে এখন আমাদের অনেক খুশি হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত বাড়ির কারোর মুখে তেমন খুশির ছিটেফোঁটাও দেখতে পায়নি।
গতকাল যে সময় আমাদের রেজাল্ট দিয়েছে ২০১৭তেও ঠিক ঐ একই সময়ে ভাইয়ার রেজাল্ট দিয়েছিলো। তখন আমরা ৪জনই একই ঘরে বসে ছিলাম। সাথে চাচাও ছিলো। ভাইয়ার এক বন্ধু ফোন দিয়ে ভাইয়াকে বলেছিলো যে বুয়েটের রেজাল্ট দিয়েছে। সেদিনের মতো খুশি ভাইয়াকে আর কখনো দেখিনি। ঠিক যেন চোখ মুখ দিয়ে আনন্দ দেখা যাচ্ছিলো। আমিও সেদিন অনেক অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম।
সত্যি বলতে সেদিনের আনন্দের ১০ভাগও গতকাল নিজের রেজাল্ট দেখে পাইনি। এখন পর্যন্ত আমার পরিবারের একজনও বলেনি বুয়েটে ভর্তি হতে। আসলে কারোর সেটা বলার মতো সাহস নেই। আমার দাদা, ভাইয়ার রেজাল্ট শুনে পুরো এলাকায় বলে বেরিয়েছিলো সে কিনা আমাকে বারবার বলছে, “তুই আর বুয়েটে যাস না। দরকার হলে রাজশাহী/খুলনা ভার্সিটিতে পড়। ওরা খুব খারাপ।” কোথায় পড়বো জানিনা এখনো। IUT তে ৪১তম হয়েছিলাম CSE তে ভর্তি আছি ওখানে।
আমাদের দুই ভাইয়ের বয়স আর ক্লাস গ্যাপ ৪ বছরের। তাই ভাইয়াকে ভর্তির দিনই বলছিলাম, “তাহলে ব্যাপারটা এমন যে তুই বের হবি আর আমাদের ব্যাচ ঢুকবে ”। ভাইয়া একবার আম্মুকে বলেছিলো,“ এখানে দেখি যার বড় ভাইও পড়ে ছোট ভাইরাও বুয়েটেই আসে। তোমার ছেলে কী করবে?”
ভাইয়ার আসলে অনেক আশা ছিলো যে আমিও ভালো কোথাও ভর্তি হবো। ভাইয়ার এক বন্ধুর সাথে দেখা হলে বলছিলো, “তুমি তো সাব্বির ? তুমি নাকি অনেক ভালো ছাত্র। তুমি কী বুয়েটে আসবা? তোমার ভাই তো বলে তোমারো নাকি বুয়েটের ইচ্ছা?” আমি জানিনা ভাইয়া সবসময় কেন আমাকে পড়ালেখায় ভালো ভাবতো যেখানে আমি ভাইয়া বেঁচে থাকতে তেমন কোনো ভালো রেজাল্টই করিনি শুধুমাত্র স্কুলের পরীক্ষা বাদে।
আসলে আমার থেকে ওর ই আমার উপর বেশি ভরসা ছিলো। ভাইয়া মারা যাওয়ার পরে ভাইয়ার এক স্টুডেন্ট আর তার মা বাসায় এসে বলে, “ তোমার ভাই কিন্তু তোমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করতো। সবসময় বলতো তোমার কথা। তুমি কোথায় পড়বা এসব কথা সবসময় বলতো। ”
ভাইয়ার রেজাল্ট এর দিন ভাইয়া একটা পোস্ট দিয়েছিলো আলহামদুলিল্লাহ লিখে ফেসবুকে, আমি আবার তখন জোর করে বলেছিলাম,আমাকে ট্যাগ করতে। হয়তো আজ উলটো টা হতো। প্রথমবারের মতো ভাইয়ার খুশি হওয়ার মতো কিছু হতে পারতো এটা কিন্তু সেটা আর হলো না।
এরপর কী করবো জানিনা এখনো। এতদিন তো শুধু ভাইয়ার দেখানো পথেই এগিয়েছি। বলা যায় ভাইয়ার দেখানো পথ এখান পর্যন্তই ছিলো। এরপরের দিনগুলো কেমন হবে সেটা আর আমাকে দেখিয়ে যাওয়ার সুযোগ ভাইয়া পায়নি। জানিনা ভাইয়া কি অবস্থায় আছে,কোথায় আছে কিন্তু এখন যতটা মিস করি ততটা আগে কখনো করিনি।
আপনারা সবাই আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এত ভালোবাসার যোগ্য আমরা কিনা জানিনা।আসলে আমার শিক্ষক, বন্ধু কিংবা তেমন চিনিনা এমন অনেকেও আমাদের যেভাবে গত কয়েকবছর সাপোর্ট দিচ্ছেন এটা আমাদের কাছে কতটা মূল্যবান তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। সকলের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই।’
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের একটি হলে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী আবরারকে ৬ ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করে হত্যা করে। এ ঘটনায় ৭ অক্টোবর তার বাবা ১৯ শিক্ষার্থীকে আসামি করে মামলা করেন। এরপর মামলা তদন্ত করে পুলিশ মোট ২৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়, যাদের সবাই বুয়েটের বিভিন্ন বর্ষের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর এই মামলায় রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় আদালত।
বিএনএনিউজ/এইচ.এম।