বিএনএ,চট্টগ্রাম: দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে দ্বিতীয় দফায় ডিম ছেড়েছে মা মাছ। ডিম ছাড়ার খবর পেয়ে আহরণকারীরা উৎসবে নেমেছে।
বুধবার (২ জুন) বিকেল সাড়ে ৪টার পর থেকে ডিম ছাড়া শুরু হয়। মাছের আকার অনুযায়ী হালদা পাড়ে ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম পর্যন্ত নমুনা ডিম পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন হালদা বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে হালদার বিভিন্ন স্থানে মা মাছ নমুনা ডিম ছাড়ে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে নদীতে মা মাছ পুরোদমে ডিম ছেড়েছে। হালদা নদীর রাউজান ও হাটহাজারী অংশের আজিমের ঘাট, অংকুরি ঘোনা, কাগতিয়ার মুখ, গড়দুয়ারা নয়াহাট, রাম দাশ মুন্সির ঘাট, মাছুয়া ঘোনাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ডিম আহরণ চলছে। প্রায় তিন শতাধিক নৌকা নিয়ে ডিম আহরণকারীরা মা মাছের ডিম সংগ্রহ করেছে। গড়দুয়ারা নয়াহাট এলাকায় ডিম আহরণকারী আবদুর রহিম বলেন, প্রতি নৌকায় তিন থেকে চার বালতি করে ডিম পাওয়া যাচ্ছে
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, অনুকূল পরিবেশ পেলে মা মাছ আবারও ডিম ছাড়বে। সেই অনুকূল পরিবেশ পাওয়ায় মা মাছ ডিম ছেড়ে দিয়েছে। নদীর পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় প্রথম ধাপে মা মাছ আশানুরূপ ডিম ছাড়েনি। প্রথমবার যখন ডিম ছেড়েছে তখন হালদার পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল ৭২ শতাংশ। গতকাল (মঙ্গলবার) ছিল শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ অর্থাৎ এক শতাংশেরও কম। তাহলে মা মাছ মিঠা পানি পেয়েছে। আবার গত তিনদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে, গতকাল পাহাড়ি ঢলও নেমেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, মে মাসের চতুর্থ জো অর্থাৎ পূর্ণিমা তিথিতে হালদায় ডিম ছাড়ে মা মাছ। এবার পূর্ণিমা তিথি ছিল ২৩ থেকে ২৯ মে। এই সময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয়নি বললেই চলে। আবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসের কারণে সাগরের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে হালদায়। বৃষ্টিপাত না হওয়া এবং ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় মা মাছ ডিম ছাড়েনি। এছাড়া মঙ্গলবার (১ জুন) চট্টগ্রামে ১২৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে, সাথে ছিল বজ্রপাতও। আর সাথে পাহাড়ি ঢল আশা জাগিয়েছে, গত পূর্ণিমা তিথির ডিম শূন্যতা কাটতে যাচ্ছে এবার।
নদী গবেষক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, মা মাছের ডিম ছাড়ার জন্য অতি অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন হয়। হালদার পানি প্রতিবেশের ভৌত-রাসায়নিক বিভিন্ন মানদণ্ড এবং প্রতিবেশ পরিবেশের প্রাকৃতিক অবস্থার দ্বারা মাছের ডিম ছাড়া, ডিম প্রাপ্তি প্রভাবিত হয়। এবার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃষ্টি হয়নি।
তিনি বলেন, উজানে বৃষ্টির স্বাদু পানির প্রবাহের স্রোত, মেঘের কাঙ্ক্ষিত গর্জন, বাতাসের ঝাপটা প্রবাহ, পানির স্রোত এবং ঘূর্ণি, কার্প মাছের ডিম ছাড়তে প্রভাবিত করে। পানির বিওডি, পানির দ্রবীভূত অক্সিজেন, খরতা, অম্লতা, পিএইচ, টারবিডিটি, বাতাস ও তাপমাত্রা এবং বাতাসের প্রবাহ, অমাবস্যা-পূর্ণিমার প্রাকৃতিক প্রভাব, জোয়ার-ভাটার মিথস্ক্রিয়া, পানিতে দ্রবীভূত রাসায়নিক বিভিন্ন পদার্থের অতি অনুকূল অবস্থা- সবকিছু অতি অনুকূল থাকলে মাছ ডিম ছাড়ে।
এর আগে গত ২৫ মে রাত ১২টার পর, পরদিন দুপুর ১২টার পর ও রাত ১০টার পর তিন দফায় নমুনা ডিম ছাড়ে মা মাছ। ঘূর্ণিঝড় ইয়াছ ও পূর্নিমার প্রভাবে হালদায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় বেশিরভাগ ডিম নষ্ট হয়ে যায়। ওই সময় প্রায় ৩০০ নৌকা ও ১ হাজারের বেশি আহরণকারী মিলে মাত্র সাড়ে ৩ হাজার কেজির মত ডিম সংগ্রহ করেন। যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
জানা যায়, হালদা নদী থেকে গত বছর ২২ মে প্রায় ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম আহরণ করা হয়, যা বিগত ১২ বছরের রের্কডকে ছাড়িয়ে যায়। এর আগে ২০১৯ সালের ২৫ মে প্রায় ১০ হাজার কেজি, ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালের ২২ এপ্রিল ১৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালের ২ মে ৭৩৫ কেজি, ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল ও ১২ জুন ২৮০০ কেজি, ২০১৪ সালের ১ মে ১৬৫০০ কেজি, ২০১৩ সালের ৫ মে ৪২০০ কেজি, ২০১২ সালে ৮ এপ্রিল ২১২৪০ কেজি, ২০১১ সালে ১৮ এপ্রিল ১২৬০০ কেজি, ২০১০ সালে ২২ মে ৯০০০ কেজি ও ২০০৯ সালে ২৫ মে ১৩২০০ কেজি ডিম আহরণ করা হয়।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ রুহুল আমিন বলেন, গত দুইদিনের বৃষ্টিতে হালদায় পাহাড়ি ঢল নেমেছে। বিভিন্নস্থানে মা মাছের আনাগোনাও বেড়েছে। অনেকে তিন চার বালতি করে ডিম সংগ্রহ করেছেন। উপজেলা প্রশাসন সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আমি হালদায় অবস্থান করছি৷
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মৎস্য প্রজননক্ষেত্র এ হালদা নদী, ডিম ছাড়ার মৌসুমের তিন মাস পূর্বে কার্প জাতীয় মা মাছ দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ছেড়ে হালদার মিষ্টি পানিতে বিচরণ করতে চলে আসে। পরবর্তীতে ডিম দেয়ার সময় মা মাছেরা এপ্রিল থেকে জুন- এ তিন মাসের অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জো’তে মুষলধারে বৃষ্টি, বজ্র ও পাহাড়ি ঢলে পানির স্রোতে হালদার গভীরতম স্থানে ও বাঁকে ডিম ছেড়ে দেয়।
প্রসঙ্গত, খাগড়াছড়ি জেলার বাটনাতলী পাহাড় থেকে নেমে সর্পিল ১০৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হালদা নদী মিলেছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে। প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী বয়ে গেছে হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। এটি বিশ্বের একমাত্র জোয়ার-ভাটা নদী, যেখান থেকে সরাসরি রুই জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পূর্ণিমায় প্রবল বর্ষণ আর মেঘের গর্জনের পর পাহাড়ি ঢল নামলে হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছ স্মরণাতীতকাল থেকে ডিম ছেড়ে আসছে। এই নদীর সুরক্ষায় সরকার ইতোমধ্যে এটিকে বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ ঘোষণা করেছে। বাড়ানো হয়েছে মনিটরিং কার্যক্রম। বসানো হয়েছে হালদার ৮ পয়েন্টে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিসি ক্যামেরা। এছাড়া সম্প্রতি চারটি স্থানে স্থাপন করা হয়েছে সিসি ক্যামেরা। এই চার ক্যামেরার মাধ্যমে দেড় কিলোমিটার করে আরও ৬ কিলোমিটার হালদা নদী সিসি ক্যামেরার আওতায় আসলো। এতে অবৈধ জাল পেতে মা-মাছ নিধন রোধ, ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালাচল বন্ধ, বালু উত্তোলন বন্ধ ও ডলফিনসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় হালদা নদীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা সম্ভব হবে।
বিএনএনিউজ/মনির