শামীমা চৌধুরী শাম্মী
বিএনএ ডেস্ক : ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে যে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছিল, তার মূল কারিগর ওসামা বিন লাদেন। অথচ সেই ওসামা লাপাত্তা! তার কোন খোঁজ পাচ্ছিল না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। একযুগ আগে ২০১১ সালের ২রা মে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে নৌ বাহিনীর ২৪ সদস্য হত্যা মিশন চালিয়েছিল। কীভাবে ওসামা বিন লাদেনকে শানাক্ত ও হত্যা করা হয়েছিল তা তুলে ধরেছে প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’।
পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে সিআইএর গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ইব্রাহিম সাঈদ আহমেদ আল-কুয়েতি নামে এক ব্যক্তি ছিলেন লাদেনের অতি ঘনিষ্ঠ। তাঁর জন্মস্থান পাকিস্তানে। ইব্রাহিম সাঈদ আহমেদ ও তাঁর পরিবার অ্যাবোটাবাদের বড় একটি বাড়িতে বসবাস করেন। ওই বাড়িতেই থাকে পরিবারসহ তাঁর ভাই আবরার। সেখানে তাঁদের পরিচয় ভিন্ন। ইব্রাহিম সাঈদ আহমেদ সেখানে আরশাদ খান ও তাঁর ভাই তারিক খান নামে পরিচিত। তাঁদের জন্ম কুয়েতে। কিন্তু জাতিগতভাবে তাঁরা পশতু।
২০১০ সালের জুনে ইব্রাহিম সাঈদের মুঠোফোনের তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে চলে আসে। তাঁরা ইব্রাহিমের অবস্থান শনাক্ত করতে ও তাঁর ওপর নজরদারি করতে শুরু করেন। পারিবারিকভাবে ইব্রাহিমরা কখনোই সচ্ছল ছিলেন না, কিন্তু তাঁরা যেখানে বাস করেন সেটি অনেক দামি। এখানে উঁচু পাচিলের পাশাপাশি দুই ভাই বাড়ির ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থাও রেখেছেন। মাদ্রাসা, চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ছাড়া ওই আঙিনার বাহিরে শিশুরাও খুব একটা যায় না। ফোন কল করতে হলেও দূরে কোথাও গিয়ে তাঁরা কাজ সারেন। কখনোই তাঁদের বাড়ির অবস্থানের কথা বলেন না তাঁরা।
২০১১ সালে জানুয়ারির দিকে সিআইএর গোয়ান্দারা নিশ্চিত হন ওসামা বিন লাদেন ইব্রাহিম সাঈদের বাড়িতে অবস্থান করছেন। বিষয়টি জানানো হয় প্রেসিডেন্ট ওবামাকে। তিনি গোয়েন্দাদের ডেকে পাঠান। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিমান থেকে হামলা বা ভূমি থেকে হামলার বিষয়ে পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলা হয়। এরপর ১৪ মার্চ ওবামার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানানো হয়। ওভাল অফিসের এই গোপন আলোচনায় স্থান পেয়েছেন ‘আহমেদ আল–কুয়েতি’ নামের এক ব্যক্তি। ‘রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামের বিশেষ কৌশল খাটিয়ে ওই ব্যক্তি ও পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে তাঁর বাড়ির আঙিনার সন্দেহজনক ব্যক্তির গতিবিধি শনাক্তের বিষয়টি প্রেসিডেন্টের কাছে তুলে ধরছেন গোয়েন্দারা।
হিসাব করে দেখা গেছে, ওই বাড়িতে বিমান হামলা চালালে ৩০টি বোমা দরকার। আবার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করলে একই সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র লাগবে। এতে বাড়ির সবাই নিহত হবেন। প্রতিবেশীদেরও অনেকে নিহত হবেন।
প্রেসিডেন্ট ওবামা এ সিদ্ধান্ত থামিয়ে দিলেন। তিনি জয়েন্ট স্পেশাল অপারেশন কমান্ডের কমান্ডার ভাইস অ্যাডমিরাল উইলিয়াম ম্যাকরাভেনের কাছে অভিযান বিষয়ে শুনতে চাইলেন। ওই সময় তাঁর দল অবশ্য অপারেশনের বিস্তারিত ঠিক করেনি। তবে তিনি বললেন, যদি নেভি সিল দিয়ে অভিযান চালানো যায়, হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে বিন লাদেনকে ধরা বা শেষ করে দেওয়া যাবে।
২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল ছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিন বিকেলে হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে চূড়ান্ত বৈঠক হয়। অনেকেই সরাসরি আক্রমণের পক্ষে কথা বলেন। সেখানে থাকা প্রত্যেককে তিনটি বিকল্পের মধ্যে পছন্দ করতে বলা হয়। অভিযান, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বা কোনো কিছু না করা। প্রত্যেকেই নেভি সিলের অভিযানের পক্ষে কথা বলেন। সন্ধ্যার আগেই বৈঠক শেষ হয়। ওবামা বলেন, পরের দিন সকালে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবেন।
ম্যাকরাভেনের সেনারা আফগানিস্তানের জালালাবাদে প্রস্তুত ছিল। ৩০ এপ্রিল তাদের হামলা চালানোর প্রস্তুতি রয়েছে। এ দলে রয়েছে সিল টিম সিক্স থেকে বাছাই করা ২৪ সদস্য। তাঁদের প্রাথমিক পরিকল্পনায় হেলিকপ্টার ছাড়াও উড়োজাহাজ রাখা হয়েছিল। তবে তার প্রয়োজন পড়বে না বলেই মনে করেন ম্যাকরাভেন।
সেনাদের জালালাবাদ থেকে অ্যাবোটাবাদে নিতে এমএইচ–৪৭ই চিনুক হেলিকপ্টার প্রস্তুত। এ ছাড়া প্রস্তুত রাখা হয় সেনাবাহিনী ও যুদ্ধবিমান। ওই দিন সন্ধ্যায় আবার হামলার সময় নিয়ে নতুন করে আলোচনা করা হয়। হামলা পেছানো হয় এক দিন। তবে পহেলা মে রাতে অ্যাবোটাবাদের আবহাওয়া নিয়ে খারাপ খবর শোনান ম্যাকরাভেন। তিনি বলেন, সেখানে ঘন কুয়াশা থাকবে। তাই অভিযান আরও এক দিন পেছানো হয়।
সব বিবেচনা করে ২রা মে রোববার রাতে অভিযান চূড়ান্ত করা হয়। ওই দিন রাতেই হোয়াইট হাউসের ওয়েস্ট উইংয়ে যাতায়াত কমিয়ে দেওয়া হয়। সিচুয়েশন রুমে ভিডিও কনফারেন্সের ব্যবস্থা করা হয়। ল্যাংলিতে সিআইএর প্রধান কার্যালয় থেকে মিশন পরিচালনার দায়িত্ব নেন পানেত্তা। তিনি ম্যাকরাভেনের অভিযানের সর্বশেষ তথ্য প্রেসিডেন্টের কাছে তুলে ধরেছেন। অ্যাবোটাবাদের অনেক ওপরে আরকিউ–১৭০ সেন্টিনেল নামের একটি স্টিলথ প্রযুক্তির ড্রোন উচ্চ ক্ষমতার লেন্সের সাহায্যে লাইভ ভিডিও দেখাতে শুরু করেছে।
রাত ১১টার দিকে জালালাবাদ বিমানঘাঁটি থেকে অ্যাবোটাবাদের উদ্দেশ্যে দুটি স্টিলথ ব্ল্যাক হক উড়তে শুরু করে। তাতে রয়েছেন ব্ল্যাক সিল সেনারা। তাঁরা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। তাঁদের কাছে আছে হালকা অস্ত্র। কারণ, আগেই খোঁজখবর করে রাখা হয়েছে, দেয়ালের কাছে খুব বেশি প্রতিরক্ষা নেই। ১০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তান সীমানা অতিক্রম করল হেলিকপ্টার। এর পরপরই তিনটি বড় চিনুক জালালাবাদ থেকে উড়ে আফগান সীমান্তে একটি ও দুটি অ্যাবোটাবাদের অন্য পথে টহল দিতে শুরু করল।
অপারেশনের পুরোটাই দেখতে হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমের বড় স্ক্রিনে চোখ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার।অ্যাবোটাবাদের ওই বাড়ির দিকে উত্তর–পশ্চিম দিক থেকে এগোতে থাকল হেলিকপ্টার। এ সময় ড্রোন ক্যামেরায় ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার দুটি দেখা যেতে শুরু করল। এরপর সবকিছুই দ্রুত ঘটতে থাকল।
প্রথম হেলিকপ্টারটির পর দ্বিতীয়টি নামল আঙিনার বাহিরে নতুন রোপণ করা ধানের জমিতে। এরপর দ্রুত হেলিকপ্টার থেকে বেরিয়ে এলেন নেভি সিল সদস্যরা। এ সময় আলোর ঝলকানিতে অল্প কিছু দেখা গেল। নেভি সিলের সদস্যরা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। বাড়ির লোকজন চমকে গেছেন। বিন লাদেন তাঁর স্ত্রীদের বলেন, ঘরের আলো নিভিয়ে দিতে। কিন্তু তাঁরা সে সুযোগ পাননি। কারণ, সিআইএর গোয়েন্দারা আগেই ওই এলাকার বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন।
এ সময় একদল নেভি সিল সদস্য অতিথি কক্ষের কাছের গ্যারেজ এলাকা দিয়ে ঢুকে পড়েন। এ সময় একটি গুলির শব্দ শোনা যায়। ওই গুলি চালিয়েছিলেন সম্ভবত কুরিয়ার হিসেবে পরিচিত ইব্রাহিম সাঈদ আহমেদ বা আল–কুয়েতি। এর জবাব দেন সিল সদস্যরা। এতে নিহত হন তিনি। তাঁর স্ত্রীর কাঁধে গুলি লাগে। সিল সদস্যদের আরেকটি টিম মূল বাড়ির দিকে ঢোকে। বাড়ির নিচতলার শোবার কক্ষে ছিলেন ইব্রাহিমের ভাই আবরার আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী বুশরা। দুজনই সিল সদস্যদের গুলিতে মারা যান।
এরপর প্রতিটি কক্ষে গিয়ে তল্লাশি শুরু করেন সিল সদস্যরা। দুটি বড় ঘর ও রান্নাঘর পার হয়ে তাঁরা ওপরে উঠতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন। সেখানে সিঁড়ি আটকানো ছিল। তাঁরা তা উড়িয়ে দেন। এরপর তাঁরা ওপরের তলায় চলে যান। সেখানে তাঁরা ওসামা বিন লাদেনের ছেলে ২৩ বছর বয়সী খালিদকে গুলি করে হত্যা করেন। ওই তলায় আরও অনেক নারী ও শিশু ছিল। কিন্তু কাউকে তাঁদের বিপজ্জনক মনে হয়নি। এ সময় ওই বাড়িতে কেবল একজনই বয়স্ক সন্দেহভাজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন তৃতীয় তলায়।
তৃতীয় তলার দরজাও উড়িয়ে দেন সিল সদস্যরা। তাঁরা এরপর সবখানে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজতে থাকেন। সিল সদস্যদের ভাষ্য, এরপর তারা দীর্ঘকায় দাড়িওয়ালা এক লোককে দেখতে পান। তিনি দ্রুত শোবার ঘরে যাচ্ছিলেন। তাঁকে অনুসরণ করে সিল সদস্যরা। তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়া হয়। তাঁরা দেখেন, আহত বিন লাদেনকে দুজন নারী ঘিরে রেখেছেন। ওই সময় ওসামার মাথায় গুলি লেগেছিল। এ সময় নেভি সিল সদস্যরা ওই দুই নারীকে গুলি করেন এবং ওসামা বিন লাদেনের বুকে আরও গুলি করে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
পুরো ঘটনাটি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘটে যায়। ঘটনার পরপরই তা জানানো হয় ম্যাকরাভেনকে। সিল সদস্যরা সংকেত দেন ‘পাস গেরোনিমো, গেরোনিমো, গেরোনিমো’। এর অর্থ মিশন সফল হয়েছে। বিন লাদেন নিহত। এইভাবে মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্রের শত্রু ওসামা বিন লাদেন অধ্যায়ের অবসান হয়।
বিএনএনিউজ/এইচ.এম/এইচমুন্নী