।। রবিউল ইসলাম ।।
বিএনএ, ববি: বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) একাডেমিক ভবন-২ এর প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আছেন একদল শিক্ষার্থী। প্রায় ষাট থেকে পয়ষট্টি জন শিক্ষার্থীদের একটি দল। প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে থাকায় অন্য শিক্ষার্থীদের ভেতরে প্রবেশ করতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে । কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে ওই শিক্ষার্থীরা জানান, একটুপর তাদের ক্লাস শুরু হবে। ক্লাসরুমে ক্লাস হচ্ছে তাই তারা দাঁড়িয়ে আছেন।
দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা হলেন লোকপ্রশাসন বিভাগের। এই বিভাগের চলমান ৬টি ব্যাচের জন্য রয়েছে মাত্র ১টি ক্লাসরুম। ফলে নিয়মিত ক্লাস নিতে হিমশিম খেতে হয় শিক্ষকদের। এই চিত্র শুধু লোকপ্রশাসন বিভাগেরই নয় এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি বিভাগেরই চিত্র। এর মধ্যে আবার নিত্য নতুন বিভাগ খুলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এছাড়াও এক ব্যাচের ক্লাস নেওয়ার সময় একাধিক ক্লাস রুম না থাকায় পরবর্তী কয়েকটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ক্লাস রুমের সামনে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কোলাহলের কারণে ভিতরে ক্লাস নিতে সমস্যা হয় শিক্ষকদের। মনযোগ দিতে পারেন না শিক্ষার্থীরা। ভীর ঠেলে শিক্ষকদের কক্ষে যেতে হয়।
জানা যায়, ক্লাসরুম সংকটের কারণে শিক্ষকরা ঠিক মতো ক্লাস নিতে পারেন না। এতে অনেকেই কোর্সের সিলেবাস পুরোপুরি শেষ না করেই পরীক্ষা নিয়ে নেয়। এছাড়াও শিক্ষক সংকট থাকায় তাদের বিভিন্ন ব্যাচের ক্লাস নিতে হচ্ছে। আবার পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে কক্ষ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। একই সাথে অনেক ক্লাস ও পরীক্ষার খাতা দেখতে হচ্ছে। ফলে তাদের গবেষণার ধারা ব্যহত হচ্ছে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের একদিনে টানা তিন থেকে চারটি ক্লাস করাতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীর গুনগত শিক্ষা পাচ্ছে না।
শিক্ষকরাও পর্যাপ্ত সময় নিয়ে সঠিক সময়ে কোর্স শেষ করার সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে সেশনজট বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার সঠিক সময়ে সেমিস্টার শেষ করতে না পারায় এক বর্ষে দুই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদের আওতায় ২৫ টি বিভাগ রয়েছে। এই পঁচিশটি বিভাগের জন্য পাঁচতলা বিশিষ্ট একটি ভবনের দুইটি ব্লককে একাডেমিক ভবন-১ ও একাডেমিক ভবন-২ নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেখানে ২৫টি বিভাগের জন্য মোট ক্লাসরুম রয়েছে ৩৬ টি ও ল্যাব রয়েছে ৩১ টি। এদের মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের আওতাধীন ৫ টি বিভাগ যথাক্রমে অর্থনীতি বিভাগ,সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের জন্য মাত্র ১টি করে ক্লাসরুম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং অনুষদের জন্য সম্মিলিত একটি কক্ষ বরাদ্দ রয়েছে । সমাজকর্ম বিভাগ ২০২২ সালে যাত্রা শুরু করে । একাডেমিক ভবনে ক্লাসরুম না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির তৃতীয় তলায় ক্লাসরুম ও অফিসকক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কলা ও মানবিক অনুষদের অন্তর্ভুক্ত ইংরেজি বিভাগ ও ইতিহাস বিভাগের জন্য ১ টি ক্লাসরুম, এবং বাংলা বিভাগের জন্য ২ টি ক্লাসরুম বরাদ্দ থাকলেও ২৫০৫ নং কক্ষ বাংলা বিভাগ ও আইন বিভাগকে যৌথ ভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দর্শন বিভাগের জন্য কোনো ক্লাসরুম বরাদ্দ দেওয়া হয় নি। অন্য বিভাগের রুম খালি থাকা সাপেক্ষে শিডিউল করে ক্লাস নেয় বিভাগটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিস অনুষদের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের জন্য ২ টি ক্লাসরুম বরাদ্দ থাকলেও মার্কেটিং বিভাগ, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ ও ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগগুলোর জন্য মাত্র ১ টি করে ক্লাসরুম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ক্লাসরুম সংকটের কারনে প্রশাসনিক ভবনে বিজনেস অনুষদের ৪ টি বিভাগের জন্য ১ টি ক্লাসরুম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের গনিত বিভাগের জন্য ২ টি ক্লাসরুম ও ২ টি ল্যাব, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের জন্য শুধু ৬ টি ল্যাব, রসায়ন বিভাগের জন্য ১ টি ক্লাসরুম ও ২ টি ল্যাব, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জন্য ২ টি ক্লাসরুম, ২ টি ল্যাব, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের জন্য ২ টা ক্লাসরুম ও ২ টা ল্যাব এবং পরিসংখ্যান বিভাগের জন্য ১ টি ক্লাসরুম ও ১ টি ল্যাব রয়েছে। জীববিজ্ঞান অনুষদের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ক্লাসরুম ২ টা, ল্যাবরুম ৩ টা, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ২ টা ক্লাসরুম, কোস্টাল স্টাডিজ এন্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ১ টা ক্লাসরুম ও ১ টি ল্যাবরুম।
লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী রাব্বি খান বলেন, বিভাগে মাত্র একটা ক্লাস রুম থাকার কারণে একসাথে একাধিক ব্যাচের ক্লাস নেয়া সম্ভব হয় না। এক ব্যাচের ক্লাস হলে অন্য ব্যাচকে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। শিক্ষকরাও সিলেবাস শেষ করার জন্য যথেষ্ট সময় পান না। সময়মতো পরীক্ষা নিতে পারেন না। আর একটা বিভাগের জন্য একটা ক্লাসরুম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মনে হয় বিরল। তাই অতিসত্বর এই সংকট দূর করতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান থাকবে।
রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী শাহীন আলম বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের তুলনায় ল্যাব রুমের সংকট রয়েছে ৷ অনেক যন্ত্রপাতিও নেই। ল্যাব রুমের সংকটের কারণে আমাদের গ্রুপে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে আমরা ব্যবহারিক কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মিলান সরদার বলেন, ক্লাস সংকট আমাদের একটা মারাত্মক সমস্যা। বেশিরভাগ বিভাগেই একটা করে ক্লাসরুম তবে কোন কোন বিভাগে ২টা তাও আবার এক সাথে না। প্রায় সময় ৫/৬টা ব্যাচের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতো গুলো ব্যাচ ক্লাস রুম মাত্র একটা , যেকারণে স্যাররা নিয়মিত ক্লাস নিতে পারে নাহ। যার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর আমাদের কোর্স শেষ হয় না। এতে সেশনজটের সৃষ্টি হয়। মাঝে মাঝে এমনই হয় যে আমাদের ক্লাস হচ্ছে আর অন্য আর একটা ব্যাচ বাহিরে অপেক্ষা করছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে ফাইনাল পরীক্ষার সময় আমাদের অন্যদের ক্লাসরুম ব্যবহার করতে হয় আবার অন্যরা যখন আমাদের ক্লাসরুম ব্যবহার করে, ফলে আমাদের ক্লাস ওই সময় বন্ধ থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদের একাডেমিক প্রধান হলেন ডিন। অনুষদগুলোর একাডেমিক কার্যক্রম সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু তাদের জন্যও দেয়া হয়নি আলাদা কক্ষ। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় ২০১ জন শিক্ষক রয়েছেন। এসব শিক্ষকদের জন্য একক কোনো রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এক কক্ষে তিন থেকে চারজন শিক্ষককে ভাগাভাগি করে থাকতে হচ্ছে।
গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান ড.মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমাদের একটা নিদিষ্ট রুটিন করা আছে। সব রুটিন এমনভাবে করা যে কোনো একটি কারণে ক্লাস মিস হলে ক্লাসরুম সংকটের কারণে ওই ক্লাস পরবর্তীতে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ক্লাসরুম সংকটের মধ্যেই আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে ক্লাসরুম সংকট তো একদিনে শেষ হবে না যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় বড় হচ্ছে, বিভাগ বাড়ছে। এটা যদি সরকার থেকে বড় ধরনের বরাদ্দ না করে তাহলে এতো তাড়াতাড়ি এ সমস্যা শেষ হচ্ছে না।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন বলেন, সিডিউল অনুযায়ী ক্লাস নিলে ক্লাসরুম সংকটে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু সিডিউল মিস করলে ব্যাকআপ ক্লাস নিতে সমস্যা হয়। তবে দ্বিতীয় ফেজের কাজ হয়ে গেলে এ সমস্যা থাকবে না বলে আশা করা যায় ।
এ বিষয়ে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড.মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, এ বিষয়ে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে গেছে। এ সকল সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বিষয়গুলো ভিসি মহোদয়কে অবগত করেছি।
এ বিষয়ে উপাচার্যকে কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেনি পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তার উত্তর পাওয়া যায়নি।
বিএনএ/এমএফ