বিএনএ, সাভার: এক সময়ের চাষাবাদের জমিতে থরে থরে সাজানো কাঁচা মাটির ইট। রোদে পরিমাপ মতো শুকানোর পর এগুলোই উঠবে চুল্লিতে। আগুনের তাপে পুড়ে সেগুলো গড়ে উঠবে ইট হয়ে। ভাটার চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া উড়া সেই ইটভাটায় যেন পুড়ছে কোমলমতি শিশুর স্বপ্নও। লেখাপড়া ছেড়ে ঢাকার ধামরাইয়ের ইটভাটাগুলোতে নিজের শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে দিচ্ছে বহু শিশু-কিশোর।
সম্প্রতি উপজেলার কয়েকটি ইট ভাটায় গিয়ে দেখা যায়, পূর্ণবয়স্কদের মতোই ভারি কাজ করছে ৭-১৫ বছরের শিশুরাও। কম অর্থে বেশি শ্রম নিতে পারার কারণে ভাটা মালিকরা এসব শ্রমিককে নিয়োগ করে থাকেন বলে দাবি শ্রম অধিকারকর্মীদের।
কয়েকজন শিশু শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব শিশুর অনেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করছে। এখন চুক্তিতে নেমেছে এই কাজে। আবার অনেকে বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিক হয়েছে। কেউ এসেছে বাড়ি থেকে পালিয়ে, কেউ কেউ মা-বাবার সঙ্গেই ভাটায় কাজ করতে এসেছে।
ভাটাগুলোতে এসব শিশুর কাজ কাঁচা ইট রোদে শুকানো, ইট তৈরি, ট্রলিতে করে ইট টেনে ভাটাস্থলে পৌঁছানো, মাটি বহন করা ও চুল্লিতে কয়লা পৌঁছে দেয়া।উপজেলার সুতিপাড়া ইউনিয়নের বাথুলিতে কেএজেড ব্রিকসে কাজ করছিলেন তুহিন ইসলাম (১৪)। কথা হয় তার সঙ্গে। তুহিন ইসলাম জানায়, সে রংপুরের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তো। সংসার চালাতে বাবাকে সহযোগিতা করতে লেখাপড়া ফেলে সে এই ভাটায় কাজ করতে এসেছে। এখানে সে ট্রলিতে করে মাটি আনার কাজ করে।
তুহিনের মা ফাতেমা বেগম বলেন, ছয়-সাত মাস ভাটায় কাজ করে আবার গ্রামে ফিরে যাবে ওরা। রুটিরুজির জন্য ছেলের পড়ালেখার ক্ষতি হলেও কিছুই করার নেই।
উপজেলার এএমসি ব্রিকসে কাজ করে সুমন ইসলাম। রংপুরের বাসিন্দা সেও।জানায় দুই বছর আগে সিক্সে পড়তো সে। পরে পড়ালেখা বাদ দিয়ে বাবার সঙ্গে কাজে আসে। এরপর আর ফেরা হয়নি।
তার বাবা সামাদ উদ্দিন বলেন, ‘লেখাপড়ার দিন কি শেষ হইয়া গেইছে? আরও আইছেছি সেলা (তখন) পড়িবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাটায় একটি কাঁচা ইট তৈরিতে তিনজন শ্রমিকের প্রয়োজন। যে পরিবারে তিনজন সদস্য থাকে, তাঁরা প্রতিদিন কাজ করে প্রায় এক হাজার টাকা আয় করেন। তাই অধিকাংশ শ্রমিক তাঁদের ছেলেমেয়েকে নিয়ে আসেন।’
উপজেলার শোলধন গ্রামের ভাটায় ছেলেসহ (১১) কাজ করেন করিম হোসেন। পাশেই আরেক ভাটায় ইমরান হোসেন (১৩), সাগর মিয়া (১৬), শরীফুল ইসলাম (১১), সোহেল রানা (১৪)। এরা অনেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার পর বছর দু-এক ধরে তারা ইটভাটায় কাজ করছে। এদের মতোই উপজেলার অন্তত ২০টি ভাটায় ঘুরে প্রায় ৫০ জন শিশুকে ভাটায় কাজ করতে দেখা যায়।
এএ্যান্ডসি বিক্সের ব্যবস্থাবক বালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আহমদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের এখানে কোন শিশুই কাজ করে না। আমরা তাদেরকে রাখি না। আমার ইটভাটাতে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় না।’
ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. নূর ই রিফফাত আরা বেগম বলেন, ‘শিশু শ্রম সরকারিভাবেই নিষিদ্ধ। ফলে যারা কাজ করায় তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া উচিত’।
তিনি বলেন, ‘ইটভাটায় কাজ করতে গিয়ে শিশুরা শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়ার পাশাপাশি তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, অ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’
ধামরাইয়ে গেল ৫ বছর ধরে শিশু শ্রম বন্ধে কাজ করছেন রাহাত বিন এস রহমান আবিদ। তিনি বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করলে বা আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করে শিশুকে চাকরি করার অনুমতি দিলে, তিনি পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এবিষয়ে জানতে ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সামিউল হক ও উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অন্তরা হালদারকে ফোন করা হলে তারা ফোন রিসিভ করেননি।
বিএনএ/ ইমরান খান,ওজি