বিএনএ, কক্সবাজার: কক্সবাজার শহরের প্রাণ হিসেবে পরিচিত বাঁকখালী নদীর তীরে দখলের মহোৎসব চলছে। একইসঙ্গে ময়লা-আবর্জনার স্তুপে নদী গতি হারিয়ে ভরাট ভূমিতে পরিনত হয়েছে। শুধু তাই নয়, নদীর তীরে ৯ শ’ হেক্টর প্যারাবন নিধন করে একে একে চলছে অবৈধ স্থাপনা নিমার্ণের কাজ। ২ মাসের ব্যবধানে নদীর তীরের ৩ শত হেক্টর জমি চলে গেছে প্রভাবশালীদের দখলে। থেমে নেই স্থাপনা নিমার্ণ কাজও।
সম্প্রতি বাঁকখালী তীরের শতশত হেক্টর ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট ধ্বংস করে স্থাপনা নির্মাণের দৃশ্য ও ময়লা আবর্জনার স্তুপ দেখে হতবাক হয়েছেন বেন এর প্রতিষ্টাতা সভাপতি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার সহসভাপতি ড,নজরুল ইসলাম,ও বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলের নেতৃত্বে বিভিন্ন পরিবেশ বাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
সর্বশেষ গত ২৪ জানুয়ারি সরেজমিনে দখলের দৃশ্য দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আদালতে যাওয়ার কথা বললেন। তাঁর সরেজমিনে পরিদর্শনের কিছুক্ষণ পরে ঘটনাস্থলে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারি কমিশনার ভূমি।
পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এনভায়রনমেন্ট পিপল’ এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ জানান, খুরুশকুলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য কস্তুরাঘাট পয়েন্টে বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মান করা হচ্ছে একটি সেতু। এই সেতুটি নির্মিত হলে খুরুশকুল ও বৃহত্তর ঈদগাঁও অঞ্চলের সঙ্গে শহরের বিকল্প সড়ক যোগাযোগ তৈরি হবে। কিন্তু এই সেতুটিই যেন বাঁকখালী নদীটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। সেতুর পাশাপাশি সংযোগ সড়ক তৈরি হওয়ায় সড়কের দুই পাশে প্যারাবন ধ্বংস করে নদী দখলের মহোৎসবে মেতে ওঠেছে প্রভাবশালী চক্র। একে এক দখলের মহোৎসব চললেও প্রশাসন অনেকটা নিরব।
তিনি জানান, এই নিরবতায় গত ২ মাসে নদীর শত হেক্টর জমি দখল করে তৈরি হয়েছে স্থাপনা। প্রশাসনকে বারবার বলা হলেও কার্যত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গত ডিসেম্বর মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর দখলদারদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করলেও থেমে নেই দখল তৎপরতা। আর এসব মামলায় কেউ গ্রেফতারও হয়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তর, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও বিআইডবিউটিএ এর পৃথক প্রতিবেদনে বাঁকখালী নদী দখলের সাথে জড়িত ১৩১ জনকে চিহ্নিত করছে। যার মধ্যে নতুন নির্মিত সেতু ঘিরে দখলের মহোৎসবে জড়িত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। যাদের মধ্যে ২৩ জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলাও করেছে।
এ দখলে জড়িত রয়েছে শহরের বদরমোকাম এলাকার জসিম উদ্দিন, হোটেল তাজসেবা খাইরুল ইসলাম জিসান, নতুন বাহারছড়া গিয়াস উদ্দিন, মাসেদুল হক, ঝাউতলার মো. আলী মুন্না, নতুন বাহারছড়ার জনি, মুজিবুর রহমান, বদর মোকাম এলাকার কপিল উদ্দিন এ্যানি, রুমালিয়ারছড়ার মো. ইসমাইল, ঝাউতলা এলাকার আনিছ মোহাম্মদ টিপু, শাহীনুল হক, নেত্রকোনা থেকে আসা ওমর ফারুক, রামুর হেলালুর রশিদ, টেকনাফের মো. ইউনুচ বাঙ্গালী, শফিক মিয়া, ঝিলংজার নুরুল আলম, বাহারছড়ার শহীদুল হক, কাইয়ার, মেহেদী, নুরপাড়ার তায়েফ আহমদ, তাইছাদ সাব্বির, সিটি কলেজ এলাকার আবদুল মালেক ইমন, পাহাড়তলীর আরিফুল ইসলাম, খুরুশকুলের নুরুল আমিন, মহেশখালীর কুতুবজোমের মেহেরিয়াপাড়ার রোকন উদ্দিন, মহেশখালী পৌরসভার, চরপাড়ার মো. ইউচুফ, সাতকানিয়া কাঞ্চনার শরিফুল আলম চৌধুরী, মহেশখালী পুটিবিলা এলাকার জাহেদুল ইসলাম শিবলু, বদরমোকাম এলাকার মো. কামাল ওরেফে কামাল মাঝি, সাতকানিয়া পশ্চিম ডলুর জসিম উদ্দিন, বাঁশখালী চনুয়ার জিয়া মো. কলিম উল্লাহ, লোহাগাড়া চৌধুরীপাড়াস্থ উত্তর হরিয়া এলাকার খোরশেদ আলম চৌধুরী, মনোহরগনজয়ের দক্ষিণ সরসপুর বাতাবাড়িয়া এলাকার ফিরোজ আহমদ, বদর মোকাম মিজানুর রহমান, চট্টগ্রামের চাদগাঁও এলাকার মাহমুদুল করিম, কক্সবাজারের লালদিঘীপাড় এলাকার আশিক, কক্সবাজার সদর উপজেলার হাজীপাড়ার আমীর আলী, রামু চাকমারকুলের মোস্তফা কামাল, বৈল্যাপাড়ার আমিন, রুমালিয়ারছড়াস্থ এবিসি ঘোনা এলাকার মো. ইসলাম ওরফে খোল বাহাদুর, বদরমোকাম এলাকার মো. ইব্রাহীম, পানবাজার সড়কের মারুফ আদনান, কস্তুরাঘাটের ইশতিয়াক আহমেদ, ইকরা রিয়েল এস্টেট হাউজিং এর মালিক আমিনুল ইসলাম আমান, খুরুশকুল মনুপাড়ার মোহাম্মদ সেলিম প্রকাশ বার্মায়া সেলিম, কক্সবাজার শহরের হোটেল তাজসেবার মাহবুবুর রহমান, মধ্যম বাহারছড়ার মো. রানা, লালদীঘির পাড় এলাকার ঝুমা ও মহেশখালীর শাপলাপুরের দীনেশপুর এলাকার ইকবাল হাসান।
বাঁকখালী নদী পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, পরিদর্শনে এসে দখলের দৃশ্যটি অত্যন্ত বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এদেশে নদী রক্ষার যে আইন গুলো আছে, প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, উচ্চ আদালতের যে রায়গুলো আছে সেগুলো একেবারে অর্থহীন করে ফেলা হয়েছে। আালতের রায়ে বলা হয়েছে নদী হলো জীবন্তু সত্তা। মানুষকে হত্যা করলে যেমন শাস্তি হয়, সেরকম নদীকে হত্যা করলেও শাস্তি হবে। ব্রীজ থাকে নদীর উপরে, এখানে ব্রীজ হয়েছে বাড়ি ঘরের উপরে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এখানে নদী রক্ষায় তৈরি করা বিশাল প্যারাবন নিধন করে ফেলা হয়েছে। এখানে যে ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে যেখানে জোয়ারের পানি দেখা যাচ্ছে, নিধন করা প্যারাবনের গাছও দেখা যাচ্ছে। প্রকাশ্যে এ নদী হত্যায় আদালতের যে রায় আছে তার মতে কি বিচার হচ্ছে এটা দেখতে হবে। সরকার কেন মনে করছে এ রায় মানতে হবে না?’
বিষয়টি আবারও আদালতে উপস্থাপন করা হবে বলে জানান বেলার এই প্রধান নির্বাহী।
বেলার প্রধান নির্বাহীর পরিদর্শন শেষ হওয়ার পর বিকাল ৪ টায় বাঁকখালী নদীর তীরের দখল স্থান পরিদর্শনে যান কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া, সদরের সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. জিল্লুর রহমান, পরিবেশ অধিদপ্তর, বনবিভাগ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এসময় একটি নতুন স্থাপনাও উচ্ছেদ করা হয়।
এসময় কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, যে স্থাপনাটি উচ্ছেদ করা হয়েছে ওটাতে বনায়ন করতে বন বিভাগকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব অবৈধ দখল যে কোনভাবে উচ্ছেদ করা হবে। তবে দখল উচ্ছেদ নিয়ে কিছু আইনী জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। নানা কারণে কিছু জমি খতিয়ানভূক্ত হওয়ায় এই জটিলতা তৈরী হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসক, নদী রক্ষা কমিশন সহ সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করা হচ্ছে। আইনী জটিলতা বিবেচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিএনএ/ফরিদুল,এমএফ