15 C
আবহাওয়া
৬:০৫ অপরাহ্ণ - জানুয়ারি ২, ২০২৫
Bnanews24.com
Home » আলোর ভিতর অন্ধকার

আলোর ভিতর অন্ধকার

আলোর ভিতর অন্ধকার

।। ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী ।।

ইঞ্জিনিয়ার বিল্ডিং, ব্রিজ তৈরি করতে পারেন, ডাক্তার অপারেশন করতে পারেন, মানুষ চাইলে বিমান তৈরি করতে পারেন, পারমানবিক বোমাও বানাতে পারেন কিন্তু একজন ভালো মানুষ তৈরি করা তার চেয়ে বড় কঠিন। দুনিয়াতে অনেক সফল ক্ষমতাধর মানুষ নিজের সন্তানদের মানুষ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সম্পদ যদি নিজের সন্তানের নিরাপত্তার গ্যারান্টি হতো তাহলে দুনিয়ার সেরা ধনী বিল গেটস সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত হতো না। ১৪ বছর বয়স না হলে সন্তানের হাতে সেলফোন তিনি তুলে দেননি এবং সবাইকে এই নিয়ম পালন করতে আহ্বান জানিয়েছেন।

তাঁর নিকট অর্থ নয় সন্তান ও পরিবারের সুখই প্রকৃত সুখ। সন্তান যদি প্রকৃত আদর্শের শিক্ষা না পান তাহলে সম্পদ যে ধ্বংসের কারণ হয় তা তিনি বুঝতেন। আমাদের দেশে ঐশি নামের মেয়েটি হতে পারে সেরা উদাহরণ। ধনী মা-বাবার অতিরিক্ত আদরে পথভ্রষ্ট হয়ে এক সময় নিজের পিতা মাতাকে হত্যা করে ঐশি। আপন জুয়েলার্সের মালিকের সন্তান ঐশি মা বাবার অন্যায় আদরের ফলে বখাটে হওয়ার কারণে তার পিতা-পুত্র দেশবাসীর নিকট প্রচণ্ড ঘৃণার প্রাণীতে পরিণত হয়েছে।

মার্কিন এক স্পীকার বলেছেন, ‘আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে শিশুর শৈশব নেই, ৩ বছর বয়সে স্কুলে যেতে হয়। খেলার মাঠ নেই, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র নেই, ১২ বছর বয়সে কিশোরী মা হয়, ১৪ বছরের কিশোর বাবা হয়, বাবা মা সন্তানের হস্তাকর হয়। প্রতিবেশী অপরিচিত ও নিষ্ঠুর হয়’। এসব বিষয় আমেরিকার বেলায় যেমন সত্য, বাংলাদেশের বেলায়ও সত্য।

বর্তমান যুগের একটি স্লোগান ‘গ্লোবাল ভ্যালেজ’ বিশ্বপল্লী। বিশ্বায়নের যুগে আমরা আমাদের সন্তানদের বিশ্বের নাগরিক হিসেবে গঠনতো দূরের কথা মানুষই তৈরী করতে পারছি না। দিন দিন অমানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অপরাধ বাড়ছে, আর দাবি করছি এখন আমরা বিশ্বের নাগরিক।

কবিরা কাল্পনিক হয়। কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ায়। অনলাইন আবিষ্কারের বহু বছর পূর্বে কবি কাজী নজরুল ইসলাম কল্পনার জগতে বিচরণ করে বলেছিলেন, বিশ্ব জগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’। কবির কল্পনা এখন বাস্তব। একটি মোবাইল সেটে আমরা হাতের মুঠোয় দুনিয়ার সবকিছু দেখতে পাই। দুনিয়ার সমস্ত ভালো কিছু, সমস্ত খারাপ কিছু সবই আমার হাতের যাদুর বক্সে আছে। যখন আমাদের সন্তানদের হাতের মুঠোয় সমস্ত ভালো-খারাপ দুটিই রয়েছে, যখন আমার তরুণ সমাজ মাথা ঠিক রাখা কঠিন। ভাল মন্দ দুটি সামনে থাকলে মন্দটাই আকর্ষণ করা মানুষের জন্মগত চরিত্র। তুলসী দাস বলেছেন, ‘মদ বিক্রি করতে হয় এক স্থানে বসে, নেশার টানে সবাই জড়ো হয়, আর দুধ বিক্রি করতে হয় ঘরে ঘরে গিয়ে’। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ তরুণ সমাজের অধিক থাকে।

জীবনের এক এক বয়সে এক এক অনুভূতি কাজ করে। তরুণ বয়সের অনুভূতি আবেগ অন্য রকম হয়। অনলাইন জগৎ তরুণদের সামনে দুনিয়ার সব দৃশ্য হাজির করছে। এমন সময় তরুণরা সেরা নায়ক নায়িকাদের অনুসরণ করতে চেষ্টা করে। মুম্বাই সিনেমার নায়করা দাঁড়ি রাখলে তরুণ সমাজ দাঁড়ি রাখে। নায়করা দাঁড়ি কেটে ফেললে তরুণরা কেটে ফেলে। যে নায়ক নায়িকার জীবন তরুণ সমাজ অনুসরণ করছে সে নায়ক নায়িকা যদি একের পর এক সংসার ভেঙে, ১০/১৫ বছরের কম বয়সী ছেলেকে বিয়ে করে, সন্তান ধারণ করতে না চায়, সংসার জীবনে চরম অসুখী হয়, তাদের অনুসরণ করলে আমাদের তরুণ সমাজ ‘আগামীর বাংলাদেশ’ এগিয়ে যাবে কী করে! আগেরকার দিনের নায়ক নায়িকাদের জীবন এ ধরনের অনিয়মে ভরাছিল না। তথাকথিত আধুনিক সমাজ আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।

পশ্চিমারা এক সময় চাইলো এক পুরুষ একটি বিয়ের অধিক করতে পারবে না, তাই হয়েছিল। তারপর চাইলো ফ্যামেলী ভেঙে দিতে, ভেঙে গেল, তারপর চাইলো লিভ টুগেদার, তা পেল, তারপর চাইলো পুরুষে পুরুষে বিয়ে তাও আইন করলো। এখন প্রশ্ন হলো তারপর কী চাবে? তারপর কোন কিছুই মানতে চাবে না। পশুর চেয়ে অধম হয়ে যাবে। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় পশ্চিমাদের প্রভাব দ্রুত পড়ছে আমাদের দেশে। বাংলাদেশে দিনে দিনে ধর্ষণ বাড়ছে। সাথে সাথে শিক্ষার হার গোল্ডেন এ-প্লাসের হার বাড়ছে। কমছে না অপরাধ। ভারতে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড আইন পাস করছে। তারপরও ধর্ষণ কমছে না। কারণ কোন জাতির নৈতিক শিক্ষা ও তাকওয়ার চর্চা না হলে উন্নত করা সম্ভব নয়। শিক্ষা যদি মুক্তি আনতো তাহলে শিক্ষকের হাতে ছাত্রী ধর্ষণের হার বাড়তো না।

উন্নতির পরিমাণ করতে পারছি, কিন্তু সাথে সাথে যে অবনতি হচ্ছে তার পরিমাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। উন্নত পশ্চিমা রাষ্ট্রে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, শিশুর ওপর যৌন নির্যাতন বাড়ছে। প্রকৃত উন্নতিতে জাতি অন্ধকারের কানা গলিতে হারিয়ে যাওয়ার কথা না। ধর্ষণ কোন রোগ নয়, সামাজিক রোগের বহিঃপ্রকাশ। সমাজ যে রুগ্ন তা ধর্ষণ দ্বারা বুঝা যায়। যতটুকু উপরে যাচ্ছি সামাজিক পচন আমাদের টেনে নিচে নামাচ্ছে। এক সময় ব্রিটেনের মন্ত্রীসভা হতে নারী কেলেঙ্কারির অপরাধে একাধিক মন্ত্রীকে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তা শুনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘এই ধরনের অপরাধের জন্য যদি মন্ত্রীসভা হতে মন্ত্রীকে বিদায় করতে হয় তাহলে আমার মন্ত্রীসভায় একজন মন্ত্রীও থাকতে পারবে না’।

প্রকৃতপক্ষে যে সমাজে অবাধে নারী পুরুষ মেলামেশা, সমাজে নারী ভোগ একগ্লাস পানি পান করার মত বিষয়, সে সমাজে নারী কেলেঙ্কারী অপরাধ হয় কী করে! ব্যবস্থার পরিবর্তন না করে অবস্থার পরিবর্তন করা যায় না। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন শুধু আইন দ্বারা হয় না। নৈতিকতার শিক্ষা প্রয়োজন।

অপরাধী শাস্তি প্রদানের জন্য ফাঁসির ব্যবস্থা আছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের আইন আছে, জরিমানার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু মানুষ সংশোধনের কোন যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারেনি। যন্ত্র দ্বারা অন্তর পরিবর্তন হয় না। তার জন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা। আধুনিক যুগে সমাজ চিন্তকরা প্রশ্ন তুলেছেন, যে শাসক নৈতিক শিক্ষা দিতে পারবে না, সে শাসকের অনৈতিক কাজের শাস্তি দিতে পারে কি না? হয়রত মাওলা আলী (রা.) বলেছেন, ক্ষুধার যন্ত্রণায় কেউ রুটি চুরি করলে, চোরের হাত নয়, সে দেশের শাসকের হাত কেটে দেওয়া উচিৎ।

হযরত ওমর (রা.) এক প্রদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সে প্রদেশে চুরির জন্য হাত কাটা নিষিদ্ধ করেন। কারণ অভাবের কারণে চোরের হাত কাটলে, একে অপরের হাত কাটতে হবে। এভাবে হাত কাটা চলতে থাকলে শেষ ব্যক্তির হাত কাটার জন্য কারো দুটি হাত অবশিষ্ট থাকবে না। ইসলাম ধর্ম এমন নির্মম ধর্ম নয়, সবাইকে হাত কাটা জাতিতে পরিণত করবে। ইসলাম অভাব চোর নয়, স্বভাব চোরের হাত কাটার নির্দেশ দিয়েছে। আজ আমাদের সমাজ উল্টো করে।

লেখক: কলাম লেখক ও রাজনীতিক

বিএনএনিউজ/ বিএম/এইচমুন্নী 

Loading


শিরোনাম বিএনএ