16 C
আবহাওয়া
১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ - ডিসেম্বর ২২, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » বীরকন্যা প্রীতিলতা: স্মরণে মরমে

বীরকন্যা প্রীতিলতা: স্মরণে মরমে

বীরকন্যা প্রীতিলতা: স্মরণে মরমে

।। ওসমান গনী।।

২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সাল।  আজ থেকে ঠিক ৯০ বছর আগে  চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণের নেতৃত্ব দেন প্রীতিলতা। আক্রমণ শেষে আহত অবস্থায় ফেরার পথে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এড়াতে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন তিনি।ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী বীরকন্যা।একজন নারী হয়েও সংগ্রামের যে দীপ্তশিখা তিনি জ্বালিয়ে গেছেন তা যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়াবে।

ডা. খাস্তগীর ইংলিশ হাইস্কুলে পড়ার সময় তিনি বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসির কথা জানতে পারেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের সংগ্রামী জীবনের অনেক ঘটনা তাঁর কিশোরী মনে রেখাপাত করেছিল।

প্রীতিলতার জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে। তাঁর বাবার নাম জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার। তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসের কর্মকর্তা ছিলেন। মায়ের নাম প্রতিভা ওয়াদ্দেদার। ছয় ভাইবোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। প্রীতিলতার ডাকনাম রাণী। ছদ্মনাম ফুলতার।

ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে লেটার মার্কসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন প্রীতিলতা। এরপর ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন। সেখানে পড়ার সময় থেকেই বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন এ বীরকন্যা। ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আইএ পাস করেন তিনি। এরপর কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ১৯৩২ সালে তিনি দর্শনে স্নাতক পাস করেন। এ কলেজে পড়ার সময় বিপ্লবী দলে মেয়ে সদস্য ও ছাত্রীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। আর ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামে ফিরে এসে নন্দনকানন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন।

এরকম সময়ে একদিন প্রীতিলতাদের বাড়িতে আসেন তার এক দাদা। পূর্ণেন্দু দস্তিদার, বিপ্লবী দলের একজন কর্মী। তিনি  বাজেয়াপ্ত কিছু বই প্রীতিলতার কাছে গোপনে রেখে যায়। কৌতূহলবশত প্রীতিলতা বইগুলো খুলে দেখে এবং একে একে পড়ে ফেলে ‘বাঘা যতীন’, ‘দেশের কথা’, ‘ক্ষুদিরাম’ আর ‘কানাইলাল’। সেই বয়সেই বইগুলো প্রীতিলতার চিন্তাজগতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। তখন তিনি সবে দশম শ্রেণির ছাত্রী। তখন থেকেই তিনি দেশের কাজে অংশগ্রহণের কথা ভাবতে শুরু করেন।

মাস্টারদা সূর্যসেন প্রীতিলতাকে জানিয়ে দিলেন, ১৯৩২ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বর রাতে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেত্রী তিনি। প্রীতিলতার মনে তখন উত্তেজনার ঝড়। পূর্বে বহুবার তিনি চেয়েছেন, এরকম কোনো অভিযানে যোগ দিতে। এতদিনে তার সে সুযোগ এসেছে। কিন্তু সশস্ত্র অভিযানের কোনো অভিজ্ঞতা তার নেই। তবে আছে আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, দেশের জন্য আত্মত্যাগের কঠিন সংকল্প।

মূল ঘটনার পূর্বে কিছুদিন কাট্টলীর সাগরপাড়ে প্রীতিলতা ও তার সঙ্গীদের অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ চলে। অভিজ্ঞ নেতারা সবরকমভাবে তাদের তৈরি কর‍তে থাকেন। আস্তে আস্তে বহুপ্রতীক্ষিত দিনটি চলে আসে। প্রীতিলতা মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকেন, দেশের মানুষের উদ্দেশে লিখে তার এই মরণখেলায় অংশ নেওয়া কথা।

ক্লাব আক্রমণে ক্লাবের একজন বাবুর্চির সহায়তার কথা উল্লেখযোগ্য। এ ব্যাপারে বিপ্লবী দলের সাথে কিছুদিন ধরেই তার যোগাযোগ ছিল। বিদেশীদের কাছ থেকে পাওয়া বাজে ও অপমানজনক আচরণের কারণে সেও ক্ষিপ্ত ছিল ওদের উপর, তাই খুব সহজেই রাজি হয়ে যায় সাহায্যের প্রস্তাবে। ঠিক হয়, তার সংকেত দেখে বিপ্লবীরা আক্রমণ শুরু করবে। প্রীতিলতা ও তার সাতজন সহযোদ্ধা সামরিক পোশাক আর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সূর্য সেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করেন ইউরোপিয়ান ক্লাবে দিকে।

পূর্বনির্ধারিত স্থানে পজিশন নেওয়ার পর বাবুর্চির সংকেতে অপারেশন শুরু করেন প্রীতিলতা ও তার দল। ক্লাবের বাইরে পাহারায় থাকা পুলিশেরা আক্রমণ হওয়ার সময়েই পালিয়ে যায়। গুলি ও বোমা ছুঁড়ে বেশ কিছু মানুষকে হতাহত করেন বিপ্লবীরা। ভেতরে থাকা আহত ইংরেজরাও এদিক ওদিক পালিয়ে যায়। খুব অল্প সময়েই সব ঠিকমতো শেষ হয়ে গেলে দলবল নিয়ে প্রীতিলতা ফেরার পথে পা বাড়ান।

যুদ্ধের নিয়ম হচ্ছে, কোনো অপারেশনে যাওয়ার সময় নেতা দলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন, আর ফেরার সময় দল থাকবে আগে আর নেতা থাকবে সবার পেছনে। সামরিক নিয়ম অনুসারে দলের সবাইকে আগে পাঠিয়ে পেছন পেছন হেঁটে আসতে থাকেন প্রীতিলতা। ফেরার রাস্তার পাশেই ছিলো একটা নালা। ক্লাব আক্রমণের সময় সেখান থেকে পালিয়ে আসা এক ইংরেজ লুকিয়ে ছিল সেই নালার মধ্যে।

এর আগে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের পর থেকেই ইংরেজরা সবসময় সাথে কোনো না কোনো অস্ত্র রাখত। নালায় আত্মগোপনরত ওই ইংরেজ সাহেবের কাছেও ছিল একটা রিভলবার জাতীয় অস্ত্র। নালার ভেতর শুয়েই এক বিপ্লবীকে খুব কাছ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে রিভালবার থেকে গুলি ছোঁড়ে ওই ইংরেজ। গুলি এসে লাগে প্রীতিলতার বুকে, সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। ঠিক সেই মুহূর্তের মধ্যেই তিনি ঠিক করে ফেলেন নিজের শেষ কর্তব্য।

এরকম কোনো অভিযানে অনেকসময় সৈনিকদের সাথে পটাসিয়াম সায়ানাইড (তীব্র বিষ) দিয়ে দেওয়া হয়। যদি এমন পরিস্থিতি আসে, যখন সে শত্রুর কাছ ধরা পড়ে যাচ্ছে- তখন তার কাজ হচ্ছে, নিজের কাছে থাকা অস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যা করা। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে ওই পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে ফেলা। অত্যাচারে মুখে দলের কোনো গোপন তথ্য যাতে বলে না ফেলে, তাই এই ব্যবস্থা। অর্থাৎ, আহত অবস্থায় শত্রুর হাতে ধরা না পড়ে আত্মহত্যা করা। প্রীতিলতাও সেই মুহূর্তে পালাবার কোনো উপায় না দেখে পটাসিয়াম সায়ানাইডটা মুখের মধ্যে ঢেলে দেন, জীবিত ধরা পড়ার ভয়ে। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ভারববর্ষের ইতিহাসের এক বীরকন্যা।

বিএনএনিউজ২৪ডটকম

তথ্যসূত্র: roar media

Loading


শিরোনাম বিএনএ