বিএনএ, সাভার: ঢাকার ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিএম স্কুল অ্যান্ড কলেজকে জাতীয়করণের জন্য তদবিরের কথা বলে সহকর্মী শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক আলী হায়দারের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষকদের বেতন আত্মসাৎসহ প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন খাতের টাকা মেরে দেওয়া এবং একাধিক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় প্রধান শিক্ষকের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। তবে এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে জানা যায়। অনেকে ধারণা করছেন অর্থ আত্মসাতকারি দুর্নীতিবাজ এই প্রধান শিক্ষক প্রশাসনসহ সকল দপ্তরকে ম্যানেজ করেছে।
ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৭ সালে যাদবপুর বিএম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলটিকে ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস। ২০১৮ সালে যুক্ত হয় কলেজ শাখা। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এর মধ্যে স্কুল শাখাটি এমপিওভুক্ত।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির সবকিছু একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন প্রধান শিক্ষক আলী হায়দার। নানা অনিয়মের বিষয় জেনেও তাঁর বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পান না। তাই তিনি নিরবে নিভৃতে গিলে খাচ্ছে এই স্কুলটির ভবিষ্যৎ।
গত ১২ এপ্রিল এলাকাবাসীর পক্ষে যাদবপুর বিএম স্কুল অ্যান্ড কলেজ নিয়ে আলী হায়দারের দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতসহ নানা অভিযোগ জানিয়ে ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন স্থানীয় বাসিন্দা সোহরাব হোসেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একই মাসে ইউএনও বিষয়টি তদন্তের জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন। ওই শিক্ষা কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতিকে নির্দেশ দেন ইউএনও।
নির্দেশ সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, তদন্ত প্রতিবেদনে ১২ এপ্রিল তিন-চারজন শিক্ষার্থীকে রুমে ডেকে শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টি প্রধান শিক্ষক স্বীকার করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণে তদবিরের জন্য তিনি বিদ্যালয়ের ১৫ জন শিক্ষকের কাছ থেকে ৫০ হাজার করে টাকা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৬ জনের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, প্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিন ইজারা দিয়ে তিন লাখ টাকা এবং লেবুবাগান ইজারা দিয়ে দুই লাখ টাকা নিয়েছেন আলী হায়দার। এ অর্থ প্রতিষ্ঠানের আয় রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ না করায় তা আত্মসাৎ বলে প্রতীয়মান হয়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক হিসাব–নিকাশে ব্যাপক অনিয়ম দেখা গেছে। শিক্ষক–কর্মচারীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণও করেন আলী হায়দার। সার্বিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
পরে ইউএনওর নির্দেশে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিযোগের জবাব চাইলে তিনি লিখিত জবাব দেন। গভর্নিং বডির সভাপতি ও যাদবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজু বলেন, ইউএনওর নির্দেশে ৭ আগস্ট প্রধান শিক্ষকের কাছে অভিযোগের বিষয়ে জবাব চাওয়া হয়। তিনি জবাব দিয়েছেন। তাঁর লিখিত জবাব ইউএনওর কাছে পাঠানো হয়েছে। এখন তিনি যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, সেভাবেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তবে এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান শিক্ষক আলী হায়দার। প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষক ও একটি স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে লেগেছে বলে দাবি তাঁর। তিনি বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ)কে বলেন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা একতরফা তদন্ত করেছেন। ২০১৫ সালের দিকে তৎকালীন সভাপতিকে শিক্ষকেরা টাকা দিয়েছিলেন। তিনি মারা গেছেন। এরপরও ৯জনের টাকা বিভিন্ন জায়গা থেকে আদায় করে দিয়েছেন বলে জানান আলী হায়দার। প্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিন ও লেবুবাগান ইজারা দেওয়ার টাকাও আত্মসাত করেননি বলেও তাঁর দাবি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যাদবপুর বিএম স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাধিক শিক্ষক জানান, প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে তদবিরের জন্য নেওয়া টাকা ৯জনকে ফেরত দেননি আলী হায়দার। এ ছাড়া করোনার সময় শিক্ষকসহ অন্যান্য কর্মকর্তার ১১ মাসের বেতন প্রায় ২৪ থেকে ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়নি। প্রধান শিক্ষক এসব টাকা আত্মসাত করেছেন।
এ বিষয়ে আলী হায়দার বলেন, করোনাকালে দেশের সব প্রতিষ্ঠানেই বেতন বন্ধ ছিল। এ সময় প্রতিষ্ঠানের আয় ছিল না, তাই বেতন দেওয়া হয়নি। টাকা আত্মসাতের প্রশ্নই ওঠে না। অথচ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক জানিয়েছেন, করোনাকালীন প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ থাকলেও ওই সময়ের বেতন প্রতিষ্ঠান খোলার পর নেওয়া হয়েছে। বেতন দেওয়ার কোনো রশিদ দেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদন নিয়ে প্রধান শিক্ষকের মন্তব্য নিয়ে ধামরাই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহীন আশরাফী জানান, সব প্রক্রিয়া মেনে প্রধান শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। কোনো পক্ষপাতিত্ব করা হয়নি।
এ বিষয়ে ধামরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ)কে বলেন, প্রধান শিক্ষক প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির কাছে লিখিত জবাব দিয়েছেন। সেটি জানানো হয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। বিষয়টি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও (ডিজি) জানানো হয়েছে।
প্রধান শিক্ষক প্রতিষ্ঠানটিতে অন্যায় আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন দাবি করে অভিযোগকারী সোহরাব হোসেন বলেন, ‘অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও কেন এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তা আমরা বুঝতে পারছি না। তবে জানতে পেরেছি, ওই শিক্ষকের ওপর মহলে অনেক লোক আছে।’ হয়তোবা তাদের ক্ষমতাই সব ম্যানেজ করে ফেলেছেন।
বিএনএ/ইমরান, এমএফ
Total Viewed and Shared : 18