34 C
আবহাওয়া
১২:১৮ অপরাহ্ণ - এপ্রিল ১৯, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » ‘‘আমার শিক্ষক আবুল হাশিম, নেতা সোহরাওয়ার্দী’’- বঙ্গবন্ধু

‘‘আমার শিক্ষক আবুল হাশিম, নেতা সোহরাওয়ার্দী’’- বঙ্গবন্ধু


।।ইয়াসীন হীরা।।

আবুল হাশিম ও শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির হাতেখড়ি । আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন এমন অনেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে  চিনেন এবং জানেন। কিন্তু  আবুল হাশিমকে কয়জনে চিনেন, জানেন? কারও বক্তব্যে তার নাম উচ্চারিত হয় না। তবে ইতিহাসকে অস্বীকার করা যায় না। রাজনীতির ছাত্র হিসেবে  নতুন প্রজন্মের কাছে আবুল হাশিমকে পরিচয় করিয়ে দিতে আওয়ামী লীগের ৭৩ বছর জন্মদিনে  আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন ।

আবুল হাশিমের জন্ম ১৯০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বর্ধমানের সদর থানার কাশিয়াড়া (কাশেমনগর) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী পরিবারে।  প্রসঙ্গত , কাশিয়াড়ার বর্তমান নাম কাশেমনগর। এটি আবুল হাশিমের পিতা মৌলভী আবুল কাশেমের নামানুসারে  গ্রামের নতুন নামকরণ করা হয়। তাঁর পরিবার জোতদার হলেও তিনি স্বীয় রাজনৈতিক জীবনকে বিকশিত করেছিলেন একজন সাম্যবাদী হিসেবে।

আবুল হাশিমের নানা ও দাদা ছিলেন সহোদর ভাই। তাঁর পিতামহ মৌলভী আবদুল মজিদ ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণীর আইএস অফিসার। তাঁর নানা নবাব আবদুল জব্বার ছিলেন ভূপাল রাজ্যের  মুখ্যমন্ত্রী।  আবুল হাশিমের পূর্বপুরুষ ছিলেন মধ্যযুগের একজন সূফি দরবেশ। তার নাম মখদুম শাহ বদরুদ্দীন।

সম্ভবত পরবর্তীকালে আবুল হাশিম তাঁর পুত্রের নাম রাখেন বদরুদ্দীন মোহাম্মদ উমর। অর্থাৎ  বামপন্থী বুদ্ধিজীবী,  লেখক বদরুদ্দীন উমরের পিতা হচ্ছেন  আবুল হাশিম।

বিহারে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর স্থাপন করা বিহার শরীফ শহরে সমাহিত হন মখদুম শাহ বদরুদ্দীন।

 আবুল হাশিম ও সোহরাওয়ার্দীর  রাজনৈতিক প্রজ্ঞা

১৯৪৭ এর ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলির ঘোষণার পর  অখণ্ডিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে ভারতবর্ষকে বিভক্ত হতে হবে! কারণ মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্ব ।

ভারতবর্ষের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে ভারতে রেখে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে নতুন দেশ পাকিস্তান গড়ার আহ্বান জানায় তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক মুখপাত্র মুসলিম লীগ। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল যেসব অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীর মানুষ প্রায় সমহারে একসাথে বসবাস করে সেসব অঞ্চলের কী হবে? কোথায় যুক্ত হবে সেসব অঞ্চল? ভারতে না পাকিস্তানে?

এই নিয়ে দর কষাকষি চলছিল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে। তৎকালীন ভারতবর্ষের এই দ্বিধাবিভক্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলা ছিল অন্যতম। অখণ্ড বাংলা থাকবে না বাংলা বিভক্ত হবে তা নিয়ে চলছিল নানা জল্পনা কল্পনা। এমতবস্থায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের বোঝাপড়ায় ভারতবর্ষের এবং একইসাথে বাংলার বিভক্তি যখন চূড়ান্ত, তখনই তৎকালীন অখণ্ড বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন, সার্বভৌম ও অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়।

এর পেছনের মূল কুশীলব ছিলেন আবুল হাশিম। তখন মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবুল হাশিম। যা  ১৯৪৭ সালে স্বাধীন বাংলার রূপরেখা  ‌‌’বসু-সোহরাওয়ার্দী’ প্রস্তাব নামে পরিচিত। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্থান মুসলিম লীগ  ভারতের কংগ্রেস তা মেনে নেয়নি। তারা ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্থান ও ভারত স্বাধীনতা চান, সীমা রেখার ভিত্তিতে নয়!

তরুণ ছাত্র নেতা শেখ মুজিব এ ব্যাপারে মহাত্মা গান্ধীর কাছে গিয়ে অখন্ড বাংলা স্বাধীনতা বিষয়ে কথা বলেন। মহাত্মা গান্ধী তা নাকচ করে দেন। পাকিস্থানের সঙ্গে দরকষাকষি করে পাকিস্থান ও ভারত ভাগ করে নেন।  আবুল হাশিম, সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবকে অন্য মুসলিম লীগ নেতারা সমর্থন করেননি, বরং বিরোধীতা করেছেন!

সে কারণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়’ ( পৃষ্ঠা ৭৯)।

ভাষা আন্দোলনে আবুল হাশিমের ভূমিকা ছিল গুরুত্বর্পূণ।  রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন সংক্রান্ত প্রথম সভায় সভাপতিত্ব করেন  আবুল হাশিম। রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধ করার প্রতিবাদ করায় তাকে গ্রেপ্তার করা হন।  এ সময় ১৬ মাস কারাগারে ছিলেন তিনি।

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খাঁ এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। জমিদারদের কবল থেকে মুসলিম লীগকে জনতার কাতারে নেয়ার কৃতিত্ব আবুল হাশিমের।  এই লড়াইয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কখনো পাশে পেয়েছেন কখনো পাননি।

সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের উদারপন্থীরা ছিল অবহেলিত। তারা নতুন একটি দল গঠন করার চিন্তা করেন।   এদের মধ্যে অন্যতম শামসুল হক, ,কামরুদ্দিন আহমদ,ইয়ার মোহাম্মদ খান,তাজউদ্দিন আহমদ,অলি আহাদ,মোহাম্মদ তোয়াহা,খন্দকার মুশতাক,শাহ আজিজুর রহমান,ইউসুফ আলী মোহন মিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান অন্যতম। এরা সবাই  আবুল হাশিমের কর্মী।ছিলেন। এক পর্যায়ে তারা মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন।

উল্লেখ, টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ পদত্যাগ করার কারণে শূন্য হওয়া একটি উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক।  কিন্তু তাদের দুজনের নির্বাচনী ফলাফলই অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।  তখন তারাও এসে এই মুসলিম কর্মীদের সঙ্গে মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভাবতে শুরু করেন।  তারা একটি সভা ডাকেন।  সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান।

কিন্তু সেই বড় সভা করার জন্য কোন স্থান পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদ তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার আহবান জানান। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সাথে যুক্ত হন।  ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন বিকালে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’

সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।  প্রথম কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে। দলের নামের সঙ্গে মুসলিম শব্দটি থাকায় পরবর্তীতে কেউ কেউ আপত্তি করছিলেন। এ নিয়ে দলে বেশ একটি বিরোধ তৈরি হয়েছিল, যে মুসলিম শব্দটি থাকবে নাকি থাকবে না।   মওলানা ভাসানী দলকে অসাম্প্রদায়িক করতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার জন্য জোর দিচ্ছিলেন, কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চাইছিলেন যে মুসলিম শব্দটি থাকুক

১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান।  পরের বছর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।  তখন হিন্দু এবং মুসলিম আসনে আলাদাভাবে নির্বাচন হতো।

১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের প্রধান তিন নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।  দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল যে, এই দলটি একটি অসাম্প্রদায়িক দল হবে। ওই নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন পায় যুক্তফ্রন্ট, যা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল, পাকিস্তান খেলাফত পার্টি আর নেজামে ইসলামী পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল।  আওয়ামী মুসলিম লীগ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ আওয়ামী মুসলিম লীগে কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়।  ফলে অমুসলিমরাও এই দলে যোগ দেয়ার সুযোগ পান। ১৯৬৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ আবার পুনর্গঠন করা হয়।

১৯৬৪ সালের কাউন্সিল সভায় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে পুরোপুরি সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক থেকে যান। কিন্তু ১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচী ঘোষণা করার পর মাওলানা তর্কবাগীশসহ অনেকেই তার বিরোধিতা করেন।

ওই বছর মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন থেকে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। যারা ছয় দফার বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের অনেক নেতাই আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।

আবুল হাশিম আজকের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতিতে দীক্ষা দেন আবুল হাশিম।  সেকারণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন  ‘আমার শিক্ষক  আবুল হাশিম,  আমার নেতা সোহরাওয়ার্দী’

বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সনে রাজনীতির শিক্ষকের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আবুল হাশিমের  প্রতিষ্ঠিত ইসলামী একাডেমীটিকেই বঙ্গবন্ধু অধ্যাদেশ জারী করে ইসলামী ফাউন্ডেশনে রুপান্তরিত করেন ।  একই বছর স্বাধীনতা পদক চালু হলে প্রথম বছরেই আবুল হাশিম স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। এ কথা কেউ জানে , কেউ জানে না!

ভারত উপমহাদেশের  মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ, ইসলামি চিন্তাবিদ এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু  আবুল হাশিম ১৯৭৪ সালে ৫ অক্টোবর না ফেরার দেশে চলে যান।

বঙ্গবন্ধু যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন আবুল হাশিমকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে গেছেন। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষক আবুল হাশিমকে এখন কেউ শ্রদ্ধা দূরে থাক স্মরণও করেন না!

 

লেখক: বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) এর নির্বাহী সম্পাদক এবং  রাজনীতি গবেষক।

 

Loading


শিরোনাম বিএনএ