35 C
আবহাওয়া
১১:২৮ পূর্বাহ্ণ - এপ্রিল ২৮, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » ৩২ নম্বরের সেই বাড়িতে একদিন

৩২ নম্বরের সেই বাড়িতে একদিন

৩২ নম্বরের সেই বাড়িতে একদিন

।।মাহমুদুল হাসান।।

২০০৮ সাল। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সকাল ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে পা বাড়ানো। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হলাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীতল ক্যাম্পাসে, মোহিত হলাম। নবীন বরণ অনুষ্ঠান হলো, এরপর যার যার ক্লাসে যাওয়ার পালা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন ছিল সাংবাদিকতায় যোগাযোগ বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। নতুন ক্লাস। বিশ্ববিদ্যায় জীবনে প্রবেশের খুশিতে বুক কাঁপছিল, সঙ্গে সবাই অপরিচিত হওয়ায় এক ধরনের শঙ্কাও কাজ করছিল। প্রথম ক্লাসেই সব শঙ্কা কাটিয়ে দিলেন অধ্যাপক কামরুন্নাহার ম্যাম। নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদের পরিচয়ও নিলেন। বললেন, বন্ধুত্ব করতে হবে সৎ, ভদ্র ও রুচিশীল মানুষদের সঙ্গে।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান পর্ব। এর মধ্যে কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবীও মিলে গেল। সবাই মিলে ঠিক করা হলো- বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখতে যাব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ধানমন্ডির শুক্রাবাদে। রাস্তা পার হলেই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি। এই বাড়ি থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছিলেন কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড ও লাল-সবুজের পতাকা। এই বাড়িতেই শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতায় রূপান্তরিত হয়েছেন তিনি। এই বাড়িতেই সপরিবারে উৎসর্গ করেছেন জীবন।

ইতিহাসেরও ইতিহাস থাকে। এই বাড়িরও একটি ইতিহাস আছে। বাড়ির গেটের উল্টো দিকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিস্তম্ভ। যার পেছনে ধানমন্ডি লেক। বৃক্ষশোভিত প্রকৃতির মধ্যে ঝলমলে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। এখানেই জাতীয় দিবসগুলোতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বস্তরের মানুষ।

বাড়িতে ঢুকতেই ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা মনে করিয়ে দেয়- বাড়িটি শুধু ইট, সিমেন্ট, বালুর ইমারত নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশও। বাড়িতে সুসজ্জিত অফিস ঘরে আসবাবের বদলে রক্ষিত ইতিহাসের সাক্ষী সব তথ্য-দলিল। একতলায় জাদুঘরটির প্রথম কক্ষে ছবির মাধ্যমে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। প্রদর্শন সামগ্রীর মধ্যে আছে শেখ রাসেলের খেলার জিনিস- বল, হকি স্টিক, ব্যাট, হেলমেট, সুলতানা কামালের সঙ্গে তার ছবি ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত পাইপ, চশমাসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তো রয়েছেই। এখানে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ব্যবহার্য জিনিস সংরক্ষণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর পড়ার ঘরসহ অন্যান্য ঘরও যথাসম্ভব একইরকম রাখা হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে এই অফিস ঘরে এসে পড়ে যান, ঘাতকেরা আবারও গুলি করে তাকে হত্যা করে। গুলি করে বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরকেও। ভবনের পরতে পরতে ঘাতকের বুলেটের ক্ষতচিহ্ন, রক্তের দাগ, সাজিয়ে রাখা বাড়ির বাসিন্দাদের স্মৃতিস্মারক, যা নিয়ে যায় বইয়ের পাতায়, ইতিহাসের অন্দরে। তবু নিবিড়ভাবে জাদুঘর দর্শনের সুযোগ পেয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি বৈঠকখানা, গ্রন্থাগার, বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ, দ্বিতীয় তলার বসার ঘর। বাদ যায় না ভবনের মূল সিঁড়িও, যেখানে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। ফুলের পাপড়ি ছিটানো সিঁড়ির দেয়ালে ঝুলছে গর্বের লাল-সবুজ পতাকা, সামনে শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের আঁকা জাতির পিতার প্রতিকৃতি।

ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে, বঙ্গবন্ধু জাদুঘরেও পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সে ইতিহাস। ১৯৭৫ সালে ঘাতকদের মূল লক্ষ্যই ছিল বঙ্গবন্ধুসহ তার পুরো পরিবার ও নিকটাত্মীয় কেউ যেন জীবিত না থাকে। সেই নৃশংস পরিকল্পনা অনুযায়ীই ঘাতকরা সেদিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে নির্মম হত্যার এক জঘন্য উল্লাসে মেতে উঠেছিল। একে একে হত্যা করেছিল ২৬ জনকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ওই সময় পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে প্রাণে বেঁচে যান। তাদের বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বাড়ির ছোট্ট ছেলে হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই সবার আদরের। রাজনৈতিক পরিবেশ ও সংকটের মধ্যেও সাইকেল আর খেলনায় ব্যস্ত রাখত নিজেকে। তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন দীর্ঘ ৯ মাস বাবাকে কাছে না পাওয়া রাসেলের বাবার প্রতি ছিল তীব্র অনুরাগ। সবসময় বাবার কাছে থাকতে জেদ করত। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেই কালরাতে পরিবারের সবাইকে হত্যা করে তাদের লাশ দেখিয়ে তারপর হত্যা করা হয় সেই শিশু রাসেলকে।
ইতিহাস বলছে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যখন চলছে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, কাজের লোকজন পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নিয়ে যায় রাসেলকে। কিন্তু ঘাতকরা তাকে দেখে ফেলে। বুলেটবিদ্ধ করার আগে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে অনুমতি নেওয়া হয়। রাসেল প্রথমে মায়ের কাছে যেতে চায়। মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিল, ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন।’ ঘাতকরা শোনেনি সে কথা। ব্রাশফায়ার করে রাসেলের মরদেহ ফেলে দেয় মায়ের লাশের ওপর।

যে বজ্রকণ্ঠ এনে দিয়েছিল বাংলার আপামর জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা, সেই বজ্রকণ্ঠকে পঁচাত্তরের সেই ভোরে শব্দহীন করে দেয় ঘাতকরা। যে আঙুলের নাচনে স্বাধীনতার স্বপ্নে নেচে উঠেছিল বাঙালি জাতি, সেই আঙুলকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতেছিল তারা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক সেই বাড়িকে সেদিন ঘাতকরা করেছিল প্রাণহীন। তাই সেই তর্জনী আর কখনো উত্তোলিত হবে না লাখো মানুষের ময়দানে, বজ্রকণ্ঠের ভাষণ রক্তে আগুন ছোটাবে না লাখো মানুষের। কিন্তু সেই তর্জনী, সেই বজ্রকণ্ঠকে কি দাবিয়ে রাখা যায়? যায় না বলেই দেহাবসান ঘটলেও জাতির পিতার অস্তিত্ব আজও বাঙালি জাতির কাছে সমান জাগরুক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি আমাদের জাতির পিতা, তার কি মৃত্যু হতে পারে? পারে না। তাই বঙ্গবন্ধু বাঙালির মনে-মননে চির অমর, ঠিক যেমন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির ওই দেয়ালে লেখা- ‘যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা/গৌরী, যমুনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান’।

বিএনএনিউজ২৪ডটকম

Loading


শিরোনাম বিএনএ