বিএনএ ডেস্ক : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যদিও গণমাধ্যমে স্বাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের আভাস দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বিএনপি যখন নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সদ্য গঠিত কিংস পার্টি জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মূখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, “হাসিনার বিচারের আগে কোনো নির্বাচন নয়”

গত ৪ মার্চ সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদদের কবর জিয়ারত শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
সারজিস আলমের এ বক্তব্যে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বিএনপি। দলটি বলেছে, কিংস পার্টি জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মূখ্য সমন্বয়ক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিএনপি নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের অভিযোগ, সারজিস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূখপাত্র হিসাবে কাজ করছেন। তিনি আরও বলেছেন, সারজিস আলমের নির্বাচনী এলাকা পঞ্চগড়-১ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে একজন পিয়নকে মনোনয়ন দিলে ওই পিয়নই বিজয়ী হবে। জামানত বাজেয়াপ্ত হবে সারজিসের।
বিএনএ’ নিউজ টুয়েন্টি ফোর টিম এই বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে তথ্য অনুসন্ধান করেছে। এবার আসা যাক, সেই তথ্য বিশ্লেষণে।
সারজিস আলম ১৯৯৮ সালের ২রা জুলাই পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিএএফ শাহীন কলেজ ঢাকা থেকে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় পাস করেন। এরপর ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচনে অমর একুশে হল সংসদে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে সদস্য পদে জয়লাভ করেছিলেন।
সারজিস আলমের জন্ম পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার আলোয়াখোয়ায়। তার বাবা আকতারুজ্জামান সাজু পঞ্চগড়ের আলোয়াখোয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। একই সাথে তিনি আলোয়াখোয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং আটোয়ারী উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ৩ পদের অধিকারি সারজিসের বাবা আখতারুজ্জামান সাজু।
আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান সারজিস আলম এবার বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে অবস্থিত জাতীয় সংসদের ১ নম্বর ও জেলার ১ সংসদীয় আসন থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টি থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। এলাকায় শীত বস্ত্র, ইফতার সামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে ইতিমধ্যে তিনি এলাকার মানুষের কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।
তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, পঞ্চগড়-১ আসনটি সদর উপজেলা, তেতুলিয়া উপজেলা ও আটোয়ারী উপজেলা নিয়ে গঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। এর আগে বৃহত্তর দিনাজপুরের অংশ ছিল এই আসনটি।
জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে পঞ্চগড়-১ আসনে নির্বাচনী যাত্রা শুরু। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সিরাজুল ইসলাম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ গ্রহণ করেনি। এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে দুই বছর পর আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেনি। নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আব্দুল কুদ্দুস সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
নব্বইয়ের গণ আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতন হয়। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির মির্জা গোলাম হাফিজ ৪৮ হাজার ৬ শত ৭৮ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগের সিরাজুল ইসলাম, পান ৩৮ হাজার ৬ শত ৪ ভোট।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৬ষ্ট সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণ করেনি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপির মির্জা হাফিজ। ওই সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ দিন। একই বছর ৩০শে জুন তত্ত্বাবধাক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী জমির উদ্দিন সরকার ৫৭ হাজার ৪শত ৩৩ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম পান ৪৮ হাজার ১২ ভোট।
২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সংসদ নির্বাচন। এতে ৮১ হাজার ৭ শত ২ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপির জমির উদ্দিন সরকার। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম পান ৭০ হাজার ১ শত ৬৪ ভোট। ৫০ হাজার ৮ শত ২৯ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন জাতীয় গণতান্ত্রিক পাটি –জাগপার শফিউল আলম প্রধান।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রার্থী মোজাহারুল হক ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫ শত ৫০ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপির জমির উদ্দিন সরকার পান ১ লাখ ৭ হাজার ৭ শত ২৬ ভোট।
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে জাসদের নাজমুল হক প্রধান, ২০১৮ সালে মোজাহারুল ইসলাম ও ২০২৪ সালের নির্বচনে নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া মুক্তা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এই তিনটি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। দেশ-বিদেশে এই তিনটি নির্বাচনের ফলাফল ছিল চরম বিতর্কিত।
প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালের পর ২০০৮ পর্যন্ত ৪টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেখা যায়, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড় -১ সংসদীয় আসনে বিএনপিই ফেবারিট।
নির্বাচন কমিশনের সবশেষ তথ্যানুয়ায়ি পঞ্চগড়-১ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৩জন। এরমধ্যে পুরুষ ২ লাখ ১৯ হাজার ৩৩৮, নারী ২ লাখ ১৭ হাজার ৫৮৪, মাত্র ১ জন তৃতীয় লিঙ্গ-ভোটার রয়েছে।
এ আসনে বিএনপি থেকে এবার প্রার্থী হতে পারেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের ছেলে কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নওশাদ জমির। এছাড়া মনোনয়ন চাইবেন পঞ্চগড় পৌরসভার একাধিকবারের মেয়র ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলাম।
জামায়াত ইসলামী ইতোমধ্যে পঞ্চগড় জেলা আমির ও তেতুলিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনের নাম ঘোষণা করেছে। এই আসনে প্রার্থী হতে পারেন প্রয়াত সফিউল আলম প্রধানের ছেলে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার সহসভাপতি রাশেদ প্রধান। জাতীয় পার্টি থেকে প্রার্থী হতে পারেন মো. আবু সালেক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন বয়কট করতে পারে। তারপরও জাতীয় নাগরিক পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী সারজিস আলমকে অন্তত হাফ ডজন প্রার্থীর সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে নামতে হবে। নির্বাচনে প্রশাসনিক কোন সহযোগীতা সারজিস আলম না পেলে জয় পাওয়া দূরে থাক, জামানত রক্ষা করা কঠিন হবে!
সৈয়দ সাকিব