ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী
বিএনএ,ঢাকা : পরিশুদ্ধ জ্ঞান মহান আল্লাহর প্রদত্ত বড় এক নেয়ামত। পবিত্র কোরআন হাদিসে জ্ঞানের গুরুত্বের কথা ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ‘ইলম’ শব্দটি ৭৫০ বারের অধিক উচ্চারণ করেছেন। কয়েক বার উচ্চারণ করলে হতো কিন্তু এত অধিক কেন ইলমের কথা বলা হলো তার রহস্য বুঝতে হবে।
দুর্যোগের সময় বৈরী আবহাওয়ার সংবাদ প্রচারের সময় উপস্থাপক বলেন, ‘দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত, আমি আবারও বলছি, দশ নম্বর মহাবিপদ দেখানো হচ্ছে,। ‘দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত’ কথাটি দুই বার বলার কারণ হলো আসন্ন বিপদের মাত্রা সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করে সাবধান করা। মহান আল্লাহ পাক যখন কোন বিষয় সম্পর্কে ব্যাপক গুরুত্ব প্রদান করেন তখন সে বিষয়টি বারবার বলে কঠোর সতর্ক করেন। জ্ঞানের গুরুত্বের ব্যাপকতা বুঝাতে আল্লাহ পাক ৭৫০ বার ইলমের কথা বর্ণনা করেছেন।
ইলম মহান আল্লাহ পাকের সিফাত। তিনি যাকে পছন্দ করেন তাকে বিশেষ জ্ঞান দান করেন। তাই হযরত শেখ সাদী (রহ.) জ্ঞানিদের মুকুটহীন সম্রাট বলেছেন।
লেখক মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীনের লেখা হতে ঐতিহাসিত একটা ঘটনা তুলে ধরতে চাই। তিনি লিখেছেন, বাদশাহ হারুনুর রশীদের আমলে জ্ঞান বিজ্ঞানের পূর্ণতা অর্জিত হয়। তিনি জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্যের প্রতি প্রচণ্ড অনুরাগী ছিলেন। এক বছর যেতেন হজে আরেক বছর যেতেন যুদ্ধে। চারদিকে তাঁর জয়জয়কার। তিনি নির্মান করেন রাককায় অবকাশ মহল। একদিন উঠেন পরিবার নিয়ে সে অবকাশ মহলে। সে সময় রাককায় গমন করেন হাদিস শাস্ত্রের পণ্ডিত ইবনুল মোবারক (রহ.)। তাঁকে দেখতে হাজার হাজার মানুষ হুড়ি হুড়ি করতে লাগলো। ধুলাবালি উড়তে থাকে, হারিয়ে যায় কত মানুষের জুতা তার নেই ইয়ত্তা। বাদশাহর স্ত্রী অবকাশ মহল হতে উঁকি দিয়ে দেখেন এই অসাধারণ দৃশ্য। দেখে বাদশাহ পত্নী বলেন, হায় দুনিয়ার রাজত্ব কী। তারা তো পুলিশ ও বিশেষ বাহিনীর সহযোগি ছাড়া মানুষ জমাতে পারে না। দুইজন সম্রাট এখানে মুখোমুখি। একজন মাটি ও রাষ্ট্রের, অন্য জন জ্ঞানের। একজনের শাসন পিটে চলে, আরেক জনের শাসন চলে হৃদয়ে। একজনের রাজত্ব পুলিশ ছাড়া অচল, অন্য জনের দরবারে পুলিশ নিষিদ্ধ। একজনের রাজত্বে সবার আছে প্রবেশাধিকার, অন্য জনের দরবার নেই। একজনের রাজত্বে রক্তপাতের সম্ভাবনা নেই, অন্য জনের রাজত্বে বন্দী এবং আছে খুনের সম্ভাবনা। আসলে জ্ঞানের রাজাই সত্যিকারের রাজা। (সূত্র: মুহাম্মদ যাইলুল আবিদীনে লেখা ‘বড় যদি হতে চাও’ গ্রন্থ দ্র:)
আরববাসীর শাসকদের মধ্যে যিনি জ্ঞান বিজ্ঞান সাহিত্য দর্শনে সবচেয়ে উন্নত তারাকা শাসক ছিলেন তিনি হলেন হারুনুর রশীদের সন্তান খলিফা মামুনুর রশীদ। তাঁর রাজ্যের পরিধিতে ছিল আজকের ৫৭টি রাষ্ট্র। তাঁর রাজ্যের প্রতিটি শহরে ছিল এক একটি মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণার জন্য তাঁর রাজদরবারে সবসময় নিয়োগ থাকতো দুই শত বিদগ্ধ আলেম। একজন ইন্তেকাল করলে তাঁর স্থানে নিয়োগ হতো আরেক স্কলার। তাঁদের জ্ঞান গবেষণায় যুক্ত হয়ে খলিফা মামুন নিজকে সমৃদ্ধ করতেন।বাদশাহ তাঁর দুই সন্তানকে সাহিত্য দর্শন আর ব্যাকরণ শিখতে অর্পণ করেন হযরত ইমাম ফাররা (রহ.)’র দরবারে।রাজপুত্রদ্বয় ইমামকে পিতৃসম মর্যাদা দিতেন। একদিন ঈমাম ফাররা (রহ.) কোথায় যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে ঈমামকে জুতা এগিয়ে দেওয়ার জন্য দুই রাজপুত্র এক সাথে এগিয়ে এসে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই নিয়ে দুই রাজপুত্রের মধ্যে ঝগড়া হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয় দুই জন দুই পায়ের দুটি জুতো ইমামের নিকট এগিয়ে দিবেন। এই ঘটনা বাদশাহ মামুনুর রশীদ শুনে ঈমামকে বললেন, আপনি যদি আমার সন্তানদের এই ধরনের মর্যাদা প্রদানে বাধা দিতেন তাহলে আমি আপনার নিন্দা করতাম। সন্তানকে শিক্ষকের প্রতি মর্যাদা প্রদানের আচরণ শিক্ষা দিয়ে সঠিক কাজটি করছেন, তাই আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
বর্তমান প্রজন্ম নিজকে আলট্রা মডার্ন ভাবে। কী ভাবে শিক্ষককে সম্মান করতে হয় তা জানে না। আমাদের সন্তানদের বিজ্ঞান প্রযুক্তির অনেক কিছু শিখাই কিন্তু মা বাবা শিক্ষককে কী রকম সম্মান করতে হয় তা আমরা শিখাতে ব্যর্থ হচ্ছি। শিখতে হয় মাতা নিচু করে, আর বাঁচতে হয় মাতা উঁচু করে। আজকের প্রজন্ম কোথায় মাথা নিচু করতে হয়, আর কোথায় মাতা উঁচু করতে হয় তা জানে না। শিক্ষকের নিকট মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় আর বাঁচতে চায় ক্ষমতাবানদের পদ লেহন করে। শিক্ষার্থী বইয়ের শুকনো পাতা অতিক্রম করে জীবনের শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতির সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে হয়। এই ধরনের শিক্ষা অর্জনে ব্যর্থ হলে সমাজে শিক্ষিত বেয়াদবের সংখ্যাই বাড়বে, দেশের কোন উন্নতি হবে না।
হযরত শেখ সাদী (রহ.)’র নিকট জানতে চেয়েছিলেন, এত আদব কোথা হতে শিখলেন, উত্তরে তিনি জানালেন, বেআদব হতে। বেআদব – যা করে তা আমি ছেড়ে দিয়েছি।’
এখন বেআদব হতে আদব শিখার সংখ্যা কমছে। বেআদবী শিখার প্রতিযোগিতা চলছে। এক সময় দেখতাম শিক্ষকদের প্রচণ্ড সম্মান করতো। এরপর দেখলাম, সম্মান না কররেও অসম্মান করতো না। এখন শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষক লাঞ্চিত হয়। তাদের হতে এ জাতি কী শিখবে। রাজ পথের আন্দোলনে সরকার পরিবর্তন বহুবার হয়েছে। কিন্তু সমাজ পরিবর্তন হয়নি। সমাজ পরিবর্তনই প্রকৃত পরিবর্তন, যে পরিবর্তনের জন্য হাজী মোহাম্মদ মুহসিন, রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়ার প্রয়োজন হয়। ছাত্ররা নিজেদের পরিবর্তন করতে না পারলে সমাজ পরিবর্তন করবে কী করে।
যে প্রজন্ম জীবিকার জন্য শিক্ষা অর্জন করে, জীবনের জন্য অর্জন করে না, সে প্রজন্ম দিয়ে সমাজ-দেশের মুক্তি কোনদিন আসবে না। অনেকে বলেন, দিন বদলে গেছে, তাই সবকিছু পরিবর্তন করতে হবে। দিন বদলেনি, সূর্য্য চন্দ্র তারা ঠিক আছে। আগের মত দিন রাত ঠিক ভাবে হয়। আমরা মানুষ বদলে গেছি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কোনটা বদলাতে হয় আর কোনটা বদলাতে নেই তা জানতে হয়। প্রজন্ম অনেক কিছু বদলাতে চায়, কিন্তু নিজকে বদলাতে চায় না। তারা বুঝতে চায় না, পৃথিবীটা বদলাতে চাইলে আগে নিজকে বদলাতে হয়। দুনিয়াতে যারা যুগে যুগে সমাজ পরিবর্তন করছেন, তাঁরা আগে নিজেই পরিবর্তন হয়েছে, এখন দেখি নিজকে গঠন করার আগে দেশকে গঠন করতে চায়।
বাইবেলে লেখা আছে, ‘অন্ধ যদি পথ দেখায়, নেতা ও অনুসারী উভয়েই খাদে পড়ে’। যে নিজের মুক্তি আনতে পারে না, সে দেশের মুক্তি আনবে কী করে। জীবন যদি লক্ষ্যহীন হয় তাহলে ব্যর্থতার জন্য অন্য কিছুই প্রয়োজন নেই। লক্ষ্যহীন মানুষ যোগ্য হলেও সফল হতে পারে না, তার শত প্রমাণ দেখে দেখে বড় হয়েছি। জাতির উন্নতির জন্য বিদ্যা নয়, প্রজ্ঞার প্রয়োজন। প্রজ্ঞার জন্য সৃজনশীলতা প্রয়োজন। কল্পনা শক্তির দ্বারা সৃজনশীলতার সৃষ্টি হয়।
সব শিক্ষক, অভিভাবক শিক্ষার্থীদের বলুন, পড়, পড়, পড়, বেশী করে পড়। আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের বলি, পড় কম, ভাবো বেশি। বর্তমান স্যোসাল নেটওয়ার্কের যুগে সময়ের অপচয়ের সাথে আমাদের সন্তানদের চিন্তাশক্তি, কল্পনা শক্তি নষ্ট করছে। সৃজনশীল যুগে সৃজনশীলতাকে নষ্ট করছে। স্যোসাল নেটওয়ার্কের যুগে কিছুই মন দিয়ে পড়ছে না, চিন্তা করছে না, বিশ্লেষণ করে না, শুধু তথ্য দেখে। তথ্যের যুগে সত্য কমছে, দেখার যুগে লেখা হারিয়ে যাচ্ছে।ফেসবুকের উদ্যোক্তা মার্ক জুকারবার্গের কথা শুনে আমি আতঙ্কিত হয়েছি। তিনি বলেছেন, ‘সৃষ্টিকর্তাই শুধু বলতে পারবে আমরা না জানি পৃথিবীর বাচ্চাদের মস্তিস্কের কী সর্বনাশ করেছি’।
প্রকৃতপক্ষে এই ভুলে সমাধান হবে কিনা জানা নেই। বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে বহু কিছুর আবিস্কার হয়েছে। মানুষ চাইলে আরো অনেক কিছু আবিস্কার করতে পারে। আমাদের সন্তানদের এমন ব্যবস্থা চাই, যা দ্বারা প্রযুক্তি যেন আমাদের সন্তানদের ব্যবহার না করে প্রযুক্তিকে যেন আমাদের সন্তানরা ব্যবহার করতে পারে।
বিএনএনিউজ/ আরএস