বিএনএ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা থেকে অপহৃত শহিদুল আলম জুয়েলকে (৩২) মাত্র ৫ ঘণ্টার মধ্যে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছে কর্ণফুলী থানা পুলিশ। পুলিশের সাহসী সিদ্ধান্ত, দ্রুত তৎপরতা ও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল এ ঘটনাকে নাটকীয় মোড় দেয়। অবশেষে অপহরণকারীরা চাপে পড়ে জুয়েলকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
ঘটনার শুরু: রহস্যময় অপহরণ
বুধবার (৫ মার্চ) রাত ১১টার দিকে কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর স্কুলের সামনের বাজার থেকে অজ্ঞাতপরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি নিজেদের নগরীর ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে জুয়েলকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিক্সায় তুলে নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বিষয়টি দেখে সন্দেহ প্রকাশ করলে পরিবার ও স্থানীয়রা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন।
গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, জুয়েলকে চান্দগাঁও থানা পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। পরিবারের লোকজন থানায় ছুটে গেলে জানা যায়, এটি সত্য নয়। জুয়েলকে কোনো পুলিশ হেফাজতে নেয়নি। তখনই পরিবারের লোকজনের সন্দেহ ঘনীভূত হয়—এটি অপহরণের ঘটনা!
মোড় ঘুরলো: পুলিশের চৌকস অভিযান শুরু
পরিবারের অভিযোগ পেয়ে কর্ণফুলী থানার ওসি মুহাম্মদ শরীফ দ্রুত তদন্তে নামেন। রাত ১টা ৬ মিনিটে জুয়েলের মোবাইল ট্র্যাক করে দেখা যায়, তার অবস্থান নগরীর খুলশী এলাকায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে লোকেশন পরিবর্তন হয়ে যায়। এরপর তার মোবাইল লোকেশন পাঁচলাইশ, লালবাজার, কোতোয়ালী—নগরীর বিভিন্ন জায়গায় দেখা যেতে থাকে। এতে নিশ্চিত হওয়া যায়, অপহরণকারীরা তাকে এক জায়গায় আটকে না রেখে বারবার স্থান পরিবর্তন করছে। অপহরণকারীরা এরই মধ্যে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। দরকষাকষির পর তারা ৫ লাখ টাকায় নেমে আসে এবং টাকা বিকাশে পাঠানোর জন্য চাপ দেয়।
অভিযানের গতি বাড়ালো পুলিশ: শহরজুড়ে চেকপোস্ট
কর্ণফুলী থানা পুলিশ বুঝতে পারে, অপহরণকারীরা তাকে গাড়িতে ঘুরাচ্ছে যাতে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারে। ওসি মুহাম্মদ শরীফ তৎক্ষণাৎ একটি চৌকস সিদ্ধান্ত নেন—শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে চেকপোস্ট বসানোর।
নগরীর নতুন ব্রিজ, কাজীর দেউড়ি, ফিরিঙ্গি বাজার, সিআরবি, মেরিন ড্রাইভসহ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশি ব্যারিকেড বসানো হয়। সব প্রাইভেটকার, কালো নোহা, হাইস ও মাইক্রোবাসগুলো চেক করা হয়। পুলিশের টহল টিম নগরজুড়ে সতর্ক অবস্থান নেয়, যা অপহরণকারীদের জন্য চরম অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
উদ্ধারের নাটকীয় মুহূর্ত!
এতকিছুর পরও বারবার লোকেশন বদলাচ্ছিল জুয়েলের ফোন। রাত ২টা ২১ মিনিটে তার ফোন ট্র্যাক করে দেখা যায়, সে কোতোয়ালী এলাকায় আছে। এরপর ২টা ৫১ মিনিটে পুলিশ নিশ্চিত হয়—অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দিচ্ছে!
এর কিছুক্ষণের মধ্যেই কোতোয়ালী থানার সামনে এক যুবককে হেঁটে আসতে দেখা যায়—তিনি ছিলেন অপহৃত জুয়েল! পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায় এবং কর্ণফুলী থানার ওসি মুহাম্মদ শরীফ সেখানে উপস্থিত হয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
কী ঘটেছিল অপহরণের পর?
ভিকটিম জুয়েল জানান, অপহরণকারীরা নিজেদের ‘ছাত্র সমন্বয়ক’ পরিচয় দিয়ে প্রথমে তাকে কথার ফাঁদে ফেলে। এরপর যাদু করেছে জানি না। তাদের কথা মতো আমিও সিএনজিতে উঠি। পরে তাকে নিয়ে নতুনব্রিজের ওপারে একটি প্রাইভেটকারে স্থানান্তর করে। পরে তারা তাকে লালদীঘি, কাজীর দেউড়ি ও নগরীর বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়।
তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে বলেছিল, তাকে রাজনৈতিক কারণে তুলে আনা হয়েছে এবং মোবাইলের সিম বদল করে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয় যাতে ট্র্যাক করা না যায়। তবে পুলিশের ব্যাপক চেকপোস্ট, নজরদারি এবং নিরবচ্ছিন্ন অভিযানের কারণে অপহরণকারীরা চাপে পড়ে যায় এবং অবশেষে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
কী বলছে পুলিশ?
কর্ণফুলী থানার ওসি মুহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘আমরা খবর পেয়েই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অভিযান চালিয়েছি। পুলিশের তৎপরতার চাপে অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। পুরো ঘটনা তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পরিবারের প্রতিক্রিয়া
ভিকটিম জুয়েলের পিতা মো. শাহ আলম সওদাগর পুলিশের সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, ‘মাত্র ৫ ঘণ্টার মধ্যে আমার ছেলেকে উদ্ধার করায় কর্ণফুলী থানার ওসি মুহাম্মদ শরীফ, এসআই মিজানুর রহমান এবং সকল টিম সদস্যদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে নিষ্ঠা ও দ্রুততার সঙ্গে কাজ করেছেন, তা অভাবনীয়!” পুলিশের বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপেই অপহরণকারীদের পরাজয়!
মাত্র ৫ ঘণ্টার ব্যবধানে কর্ণফুলী থানা পুলিশের সাহসী অভিযান ও কৌশলগত পদক্ষেপের কারণে অপহরণকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। টানা নজরদারি, চেকপোস্ট ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের ফলে তারা ভিকটিমকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
এটি নিঃসন্দেহে পুলিশের দ্রুত ও চৌকস অভিযানের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে তাদের অঙ্গীকারকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
বিএনএনিউজ/ বিএম/শাম্মী