বিএনএ,চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত ভবন রক্ষায় প্রয়োজনে মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন।
মঙ্গলবার (৫ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র’ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
কবি-সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রক্ষায় রাষ্ট্রের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা রয়েছে। সংবিধানের ২৪ ধারা সেটা উল্লেখ আছে। যাত্রামোহন সেনগুপ্তর বাড়িটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যমণ্ডিত ভবন। এ ধরনের যেসব ভবনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে তা সংরক্ষণ করতে হবে। এ নিয়ে আইনও আছে। চট্টগ্রাম আদালত ভবন রক্ষার সময়ে এই যুক্তিতে মামলা করা হয়েছিল। প্রয়োজনে যাত্রামোহন সেনগুপ্তর এই ঐতিহাসিক বাড়িটি রক্ষায় আমরা মামলায় যাব। এটির সুরক্ষা করা রাষ্ট্রের ও নাগরিকদের কর্তব্য। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র উদাসীনতা দেখিয়েছে বলে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।
সংবাদ সম্মেলনে টেলিফোনে যুক্ত হয়ে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক অনুপম সেন বলেন, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও নেলী সেনগুপ্তার বাড়িটি দখল করে সেখানে বাংলা কলেজ ও পরবর্তীতে সেখানে শিশুবাগ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা অন্যায় হয়েছে। ঐতিহাসিক সেই ভবনকে সরকার ইজারা দিয়ে অন্যায় করেছে। এরপর এখন আরেকপক্ষ এসে নিজেদের মালিক দাবি করে সেটা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করছে, সেটাও অন্যায়। ভবনটি চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। আমরা চাই না সেটি হারিয়ে যাক। ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে ভবনটি সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করে সেখানে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার দাবি করছি।
সংবাদ সম্মেলনে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, আদালত ভবন রক্ষার মতো বিপ্লবীদের স্মৃতিরক্ষায় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইনি উদ্যোগ নিতেও পিছপা হব না। চট্টগ্রাম আদালত ভবন ভাঙার চক্রান্ত যখন হয়েছিল, আমরা তা প্রতিরোধ করেছি।
তিনি বলেন, সিআরবি, পুরাতন রেল স্টেশন ভাঙার চক্রান্ত হয়েছিল। এসব অপকর্মের বিরোধিতা করেছিলাম বলে, সেই বিরোধিতা যৌক্তিক ছিল বলে, এসব স্থাপনা রক্ষা পেয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিক হিসেবে রহমতগঞ্জের ভবনটি রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।
জাল দলিল দিয়ে ঐতিহাসিক ভবনটি ভাঙার অপচেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা ভাঙতে এসেছে তারা আরজি, রায় দেখাচ্ছে না। গোপনে ফলস প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে ফলস ডকুমেন্ট দেখানোর মাধ্যমে এ আদেশ এনেছে, যা বেআইনী।
লিখিত বক্তব্যে চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আলীউর রহমান বলেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যে কয়জন বাঙালি ভারতবর্ষে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন, তাদের অন্যতম যাত্রা মোহন সেন, যতীন্দ্র মোহন সেন ও তার স্ত্রী নেলি সেন। তাদের প্রতিষ্ঠিত জেএম-সেন হল ব্রিটিশ আমল থেকে জনকল্যাণে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত রহমতগঞ্জ এলাকার যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়িটিতে অবস্থান করেছেন মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মৌলানা শওকত আলী, ড. আনসারী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, ব্যারিষ্টার আবদুল্লাহ রসুল প্রমুখ।
তিনি বলেন, যাত্রা মোহন সেনের পুত্র যতীন্দ্র মোহন সেনকে চট্টগ্রামের মানুষ মুকুটহীন রাজা বলে অবহিত করতেন। তিনি ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৫ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিই ব্যারিস্টারি করে আয় করা অর্থে বাড়িটি নির্মাণ করেন। ১৯২২-২৩ কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি পাঁচবার কলকাতার নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামে যুববিদ্রোহে নাগারখানা যুদ্ধে ও সরকারি টাকা লুটের মামলায় মাস্টার দা সূর্যসেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর হয়ে মামলা পরিচালনা করেন।
আলীউর রহমান আরও জানান, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। ১৯৩৩ সালের ২৩ জুলাই নিঃসন্তান অবস্থায় ব্রিটিশ ভারতের রাচিতে কারাবন্দি অবস্থায় মারা যান তিনি। তার স্ত্রী নেলি সেনগুপ্ত ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জ এলাকার বাড়িটিতে ছিলেন। ওই বছর তিনি ভারতের কংগ্রেস সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণে চিকিৎসার জন্য সেখানে যান। এর মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এরপর তিনি ভারতে চলে গেলে পাকিস্তান সরকার সেটিকে শত্রুসম্পত্তি ঘোষণা করে। স্বাধীনতার পর নেলি সেনগুপ্ত দেশে ফিরে দেখেন- তার বাড়িটি বেদখল হয়ে গেছে। ১৯৭৩ সালের ২৩ অক্টোবর তিনিও কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে ১৯৭৫ সালে সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে সেই বাড়িতে ‘শিশুবাগ’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা পর শামসুদ্দিন মো. ইছহাক। এরপর থেকে তার সন্তানরা সেটি পরিচালনা করে আসছিলেন।
আলীউর রহমান বলেন, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ও তার স্ত্রী নেলি সেনগুপ্ত নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। এজন্য সরকার এই সম্পত্তিকে অর্পিতসম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। পরবর্তীতে তথাকথিত ওয়ারিশ সৃষ্টি করে জাল দলিল সৃজন করে আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভবনটি ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে। যা চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য চিরতরে ধ্বংস করার একটি অপচেষ্টা।
এর আগে গতকাল সোমবার (৪ জানুয়ারি) সকালে নগরীর রহমতগঞ্জে বাড়িটি দখলে নিতে যায় একটি মহল। এসময় সেখানে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের একজন নাজিরের উপস্থিতিতে শত বছরের পুরনো ভবনটি বুলডোজার দিয়ে ভাঙা শুরু করা হয়। পরে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে ভবনটি সিলগালা করে দেয় প্রশাসন।
বিএনএনিউজ/মনির