।।মিজানুর রহমান মজুমদার।।
শিশু। জীববিজ্ঞানের ভাষায় – মনুষ্য সন্তানের জন্ম এবং বয়ঃসন্ধির মধ্যবর্তী পর্যায়ের রূপ হচ্ছে শিশু। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ০ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশুর আওতায়ধীন। শিশুদের বেশীরভাগ তাদের মা-বাবার সঙ্গে পরিবারে বসবাস ও লালিত-পালিত হয়। কিন্তু কিছু শিশু পৃথিবীর আলো দেখার পর থেকে পথেই বেড়ে ওঠে। এরা পথশিশু। পথই এদের আবাস। পথেই এদের বসবাস। রোদ-বৃষ্টি, গরম-শীত যাদের কাছে সমান।
আজ, ২ অক্টোবর, জাতীয় পথশিশু দিবস । দেশের পথশিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর আমাদের দেশে পালিত হয় এই দিবস।
স্বচ্ছল পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুরা সকালে ঘুম থেকে জেগে মায়ের হাতের মজাদার খাবার খায়। পাঠশালায় জ্ঞান অন্বেষণে ব্যস্ত তখন পথ শিশুরা তাদের আহারের জন্য সংগ্রামে নেমে পড়ে। কেউ ফুল, চকলেট, ফুল বিক্রি করে, কেউ কেউ আবার কাগজ কুড়ায়। কেউবা বয়স্ক নাগরিকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শ্রমজীবী হয়ে ক্ষুণিবৃত্তি নিবারণের অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়। রাস্তাঘাটে এক টাকা-দুই টাকার জন্য তারা পথচারীর কাছে অনুনয় করে। এসব পথশিশুরা কারও না কারও সন্তান, ভাই-বোন ও স্বজন। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তারা বিভিন্ন ধরনের অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার। তীব্র শীতের মধ্যেও তাদের প্রায়ই গরম কাপড় ছাড়া দেখা যায়, যা অমানবিক ও দুঃখজনক। ওদেরও মৌলিক অধিকারের ভিত্তিতে জীবন-জীবিকার অধিকার আছে। ভালাবাসা পাওয়া তাদের করুণা নয়, ওদের অধিকার।
কিন্তু পথ শিশু হয়ে কেউ জন্মায় না। জন্মের সময় প্রতিটি শিশু তার নাগরিক অধিকার নিয়ে জন্মায়। আজ যে শিশু ভালোভাবে কথা বলতে শেখেনি তাকেও জীবিকার তাগিদে ভিক্ষা করতে হচ্ছে। তার কাছে জীবনের মানে হলো ক্ষুধা নিবারণের জন্য পথে পথে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেঁচে থাকার লড়াই। এদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা।
পথশিশুর সংখ্যা কত? এর কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে বেসরকারি এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ২৫ লক্ষ। এরমধ্যে আড়াই থেকে তিন লক্ষাধিক পথশিশুর অস্থায়ী আবাস রাজধানী ঢাকার পিচঢালা পথে। এসব পথশিশু সমাজ-সংস্কৃতির কোন সুবিধা পাচ্ছে না। অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। সমাজের দুষ্টচক্রের সাথে নিয়তই তাদের ওঠাবসা। ছেলে শিশুদের ব্যবহার করা হয় মাদক পাচারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। মেয়ে পথশিশুদের অধিকাংশই অল্প বয়সে পতিতাবৃত্তির মতো ঘৃণ্য পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে ১৮টি মৌলিক অধিকার রয়েছে। এ সব অধিকার সুশাসন ও সুনাগরিকের রক্ষা কবচ। এক কথায় সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়ার সহায়ক শক্তি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এ মৌলিক চাহিদাগুলো যথোপযুক্তভাবে পাওয়ার অধিকার তাদেরও আছে।
দেশের পথ শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর আমাদের দেশে পালিত হয় পথ শিশু দিবস। জাতিসংঘ এবং এর অঙ্গ সংগঠন ‘ইউনিসেফ’ শিশু অধিকার ও তাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯২৪ সালে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে ‘শিশু অধিকার’ ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষর করে।
শিশু অধিকার সনদে ৫৪টি ধারা এবং ১৩৭টি উপ-ধারা আছে। এই উপ-ধারাগুলোতে বলা হয়েছে, শিশুদের ক্ষেত্রে কোন ধরনের বৈষম্য করা যাবে না। সমাজকল্যাণমূলক কাজ এবং আইনের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হবে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ। রাষ্ট্রসমূহ শিশুদের পরিচর্যা ও সরকার শিশুদের সেবা এবং সুবিধাদি প্রদান করবে। শিশুদের মৌলিক অধিকার যেমন- শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে।
পরিসংখানে দেখা যায়, বিশ্বে শতকরা ২৬ ভাগ মানুষের বয়স ১৫ বছরের নিচে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু। তাদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ শিশুই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। একটি জরিপে দেখা যায়, দরিদ্র শিশুদের ৬৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিস্কাশন সুবিধা, ৫৯ শতাংশ তথ্য লাভের অধিকার, ৪১ শতাংশ বাসস্থান এবং ৩৫ শতাংশ বিশুদ্ধ খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়।
আশার কথা, বর্তমান সরকার শিশু স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা এবং শিশু কল্যাণের লক্ষ্যে ২০১১ সালে গৃহীত হয়েছে ‘জাতীয় শিশু নীতি’। এছাড়া নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘পারিবারিক সহিংসতা আইন ২০১০’। শিশুশ্রম নিরসনকল্পে ‘জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০’ প্রণয়ন করা হয়েছে।