বিএনএ, ডেস্ক : ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। ছোটগল্প নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই চরণের মতোই অবস্থা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির।
বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের মাধ্যমে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা সরকারকে হটিয়েছে। ক্ষমতায় বসিয়েছে নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। সংস্কারের জন্য গঠন করা হয়েছে ঐক্যমত কমিশন। এই জন্য সুদুর মার্কিন মুল্লুক থেকে ড, আলী রিয়াজকে এনে দায়িত্ব দেয়া হয়।
গত এক বছরের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক দল গুলোর সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা মিটিং, ডায়লগ করে ঐক্যমত কমিশন ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি- বিএনএপির স্থায়ী কমিটির ভাষায় অনৈক্য’ প্রতিষ্ঠা করেছে কমিশন। ফলে বাংলাদেশে খুব সহসা নির্বাচন হচ্ছে না। আসছে না কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৫ মাস পরও দেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থানে আনতে পারেনি। পূরণ করতে পারেনি জুলাই শহীদের প্রত্যাশা। চারিদিকে শুধু হতাশা। চলছে দোষারোপের সংস্কৃতি। এতদিন অর্ন্তবর্তী সরকার ছোট সংস্কার ও বড় সংস্কার প্যাকেজে মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল সেই নিবাচন আদৌ হবে কীনা তা নিয়ে সংশয় সন্দেহ প্রকাশ করেছে খোদ সরকার প্রধান।
ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি নিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন বানচালের জন্য ভেতর থেকে, বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে। ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি নিয়ে বানচালের চেষ্টা করবে। হঠাৎ করে আক্রমণ চলে আসতে পারে। এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। যত ঝড়ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন, আমাদের সেটা অতিক্রম করতে হবে।’
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বুধবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে যমুনায় প্রথম সমন্বয় সভায় এমনটি বলেছেন বলে জানান প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এ দিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করেছে বলে মন্তব্য করেছেন মির্জা ফখরুল। তিনি অভিযোগ করেছেন, এই কমিশন সুপারিশমালায় রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ উপেক্ষা করেছে, যা কোনোভাবেই ‘ঐকমত্য’ হতে পারে না। বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল এ কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মির্জা ফখরুল বলেন, সত্যিকার অর্থেই যেটুকু সংস্কার দরকার, সেই সংস্কারগুলো করে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন দেবেন। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পার্লামেন্ট আসবে এবং সেই পার্লামেন্ট এই দেশের সংকটগুলো সমাধান করবে।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন ‘ জাতীয় নির্বাচন সঠিক সময়ে নাও হতে পারে। ‘ঐকমত্য কমিশন নির্বাচনের দিন বা এর আগে গণভোটের সুপারিশ করেছে সরকারের কাছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটই সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ গণভোট হবে সংস্কার প্রক্রিয়ার ওপর, আর জাতীয় নির্বাচন হবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নির্ধারণের জন্য। দুটোর চরিত্র আলাদা।’
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বুধবার সকালে কমনওয়েলথের ‘ইলেকটোরাল সাপোর্ট’ শাখার উপদেষ্টা ও ‘প্রি-ইলেকশন অ্যাসেসমেন্ট’ প্রধান লিনফোর্ড অ্যান্ড্রুজের নেতৃত্বাধীন সফররত প্রতিনিধিদলের বৈঠক শেষে এক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন তিনি।
এ দিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণহত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়।
বুধবার সন্ধ্যায় রংপুর নগরীর পর্যটন মেট্রোর হলরুমে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে তিনি এ কথা বলেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, গণহত্যার বিচার না হলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কোনো অর্থ নেই। এই বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন আয়োজন কেবলই আনুষ্ঠানিকতা, কাগজের সাইন, যার মূল্য কেবলই কাগজে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরেও দেখেছি, ত্রিদলীয় রূপরেখা শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার পথ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। জনগণের রক্তের ত্যাগ ভুলে যাওয়া হয়েছে। আমরা সেই ভুল আর করব না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মূলা দেখিয়ে গত ১৭ই অক্টোবর প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো থেকে স্বাক্ষর নিয়ে রীতিমতো কেরামতি দেখিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দীর্ঘ নয় মাস ধরে ৩০টি দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল কমিশন তার সুপারিশে এই ঐক্য ভেঙে দেয়ারই যেন চেষ্টা চালিয়েছে।
কমিশনের জমা দেয়া সুপারিশে ক্ষুব্ধ বিএনপিসহ অনেক দল। তারা বলছে, আলোচনায় ঐকমত্য হওয়া বিষয়ে কমিশন নিজের মতো সুপারিশ দিয়েছে। এতে সরকার এবং কমিশনের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ঐকমত্য কমিশন, সরকার জামায়াত ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি একই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে- এমন অভিযোগ করেছে বিএনপি।
বিভিন্ন দলগুলোর দেয়া নোট অব ডিসেন্ট বাদ দেয়া যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি তা টেনে সুপারিশে নিয়ে এসে কমিশন রীতিমতো জাতির সঙ্গে, রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এ যেন অন্ধ বিএনপির কাছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আয়না বিক্রির মতো ঘটনা। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কান্ডে নতুন করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠেছে।
কমিশনের দেয়া সুপারিশ সংশোধন না করলে নির্বাচনকে সামনে নিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে এমনকি নির্বাচনও বানচাল হতে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সৈয়দ সাকিব
![]()
