19 C
আবহাওয়া
৭:৫২ পূর্বাহ্ণ - ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪
Bnanews24.com
Home »  ভয়াল ২৯ এপ্রিল, মৃত্যুপূরী উপকূলের জনপদ

 ভয়াল ২৯ এপ্রিল, মৃত্যুপূরী উপকূলের জনপদ


বিএনএ,চট্টগ্রাম: ঘুর্ণিঝড়ের কোনো পূর্বাভাস ছিলো না, সারাদিন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছিলো, সন্ধ্যার আগ থেকে হাল্কা হাল্কা বাতাস শুরু হয়, বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে রাত দশটার পর থেকে। ঘন্টা কয়েকের ব্যবধানে রাত ১২টা নাগাদ বাতাসের সাথে সাথে উপকূলে উঠে আসে সাগরের পানি। পানি আসার ১০ মিনিট আগেও কেউ ধারণা করেনি এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমরা তখন বাজারে ছিলাম। পানির খবর পেয়ে বাড়ির দিকে যাওয়া শুরু করতেই দেখি দক্ষিণ দিকে দিয়ে ঘরবাড়ি-গাছপালা পানির সাথে ভেসে ভেসে চলে আসছে। তারপর আমরা কয়েকজন একটা ঘরের চালে উঠে পানির স্রোতের সাথে সরেঙ্গার দিকে চলে আসি। চারিদিকে পানির হু হু গর্জন। রাতের আঁধারে কিছু বুঝার কুদরত নাই। এভাবেই রাত কেটে গেলো। পরদিন সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথে দেখতে পেলাম চারিদিকে লাশ আর লাশ। শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের পরিচিত অপরিচিত মানুষের লাশে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম আনোয়ারা মৃত্যুপরীতে পরিণত হয়েছে।

পরদিন দুপুর হতে হতে পানি নেমে যায়, ভেসে উঠে ঘুর্ণিঝড়ের ক্ষত। তিনটা পাকা দালান ছাড়া আর কোনো ঘর বাড়ি অবশিষ্ট ছিলোনা আমাদের পুরো ইউনিয়নে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ভেসে আসা লাশগুলোকে গণকবর দেওয়া শুরু হয়। লাশ পঁচে দূর্গন্ধ বের হওয়ার পর স্থানীয়রা কেউ দাফন করতে না আসায় শহর থেকে মানুষ এনে লাশ দাফন করা হয়েছে। এভাবেই ১৯৯১ সালের ঘুর্ণিঝড়ের ভয়াবহতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন রায়পুর ইউনিয়ন বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক মোঃআব্দুস সালেক (৬০)।

নিজের মা বাবাসহ পরিবারের ১৮জন সদস্যকে হারিয়েছেন আনোয়ারা উপজেলার সরেঙ্গা এলাকার মো. রফিক। তিনি সে দিনকার কথা তুলে ধরে বলেন, তখন আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম, ঘুর্ণিঝড়ের আগে বেড়াতে গেছিলাম খালার বাসায়। ঘুর্ণিঝড়ের খবর শুনে পরদিন এসে দেখি এই ঘাতক ঘূর্ণিঝড়ে আমার মা-বাবাসহ পরিবারের ১৮জন সদস্য মারা গেছে। সেই থেকে আজও ২৯ এপ্রিল আসলে সেই ভয়াবহ মূহুর্তটির কথা মনে পড়ে যায়।

মা-বাবা, ভাই-বোনসহ পরিবারের ৭সদস্যকে হারিয়েছিলেন রায়পুর এলাকার ওয়াহেদ আলী বাজারের এলাকার বাসিন্দা অলি হোসেন (৫০)। সেদিন পানির স্রোতে ভেসে একটা পাকা দেয়ালে উঠতে পারায় বেঁচে গেছিলেন তিনি আর তার বড় বোন রেজিয়া বেগম (৫৫)। তার ভাষ্য মতে, সেদিন রাতে তিনি ভেবেছিলাম তার মা-বাবাও হয়তো তাদের মতো বেঁচে আছে। কিন্তু সকাল হতে হতে সে আপন মানুষগুলোর একটা একটা মৃত চেহারা তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেটা কখনো চিন্তা করেনি সে। আপনজনের মধ্যে সবার লাশ দেখারও সৌভাগ্য হয়নি তার।

এভাবে ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড়ে অনেকেই তাদের আপনজন হারিয়েছেন, কারো আপনজনদের মরদেহ দেখার সুযোগ হলেও কারোও কপালে সেটাও জুটেনি। তাই এখনো ২৯ এপ্রিল আসলে উপজেলার রায়পুর এলাকায় বিভিন্ন স্মরণ সভা, দোয়া মাহফিল ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কাটিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে কয়েক বছর সময় লেগেছিল আনোয়ারার উপকূলের মানুষের। সে ঘূর্ণিঝড়ের পর আনোয়ারার উপকূলে প্রচুর ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।

একই সাথে ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূলের মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরিয়ে আনার পদ্ধতিও বেশ জোরদার হয়েছে। আগের তুলনায় ঝড়ের সতর্ক সংকেত উপকূলের মানুষের কাছে আরো কার্যকরী ভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে ঝড়ের পর বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে একসাথে এতো মানুষ আর মারা যায়নি। যারা সে ঝড়ের প্রত্যক্ষদর্শী তাদের মন থেকে সে রাতের দু:সহ স্মৃতি হয়তো কখনোই মুছে যাবে না। সে কারণে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল এখনো বাংলাদেশের বহু মানুষের কাছে ‘ভয়াল রাত’ হিসেবে পরিচিত।

তৎকালীন আনোয়ারা এবং বর্তমান আনোয়ারার মধ্যকার তুলনামূলক পার্থক্য উল্লেখ করে আনোয়ারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুল হক চৌধুরী বলেন, তখন উপকূলে বেড়িবাঁধ ছিলোনা, এখন আনোয়ারার চারপাশে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সাইক্লোন সেন্টার, মুজিবকেল্লাসহ বিভিন্ন আশ্রয়ণকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে। সেদিন ঘুর্ণিঝড়ের কোনো পূর্বভাস ছিলো না এখন ঘুর্ণিঝড়ের অনেকদিন আগে তার পূর্বাভাস দেওয়াসহ প্রতিটা মুহুর্তের আপডেট দেওয়া হচ্ছে।  তাছাড়া এখনকার মানুষ খুবই সচেতন। ইনশাআল্লাহ আল্লাহর রহমত এবং বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ফলপ্রসুত আনোয়ারায় এখন ঘুর্ণিঝড়ে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নাই।

সূত্র বলছে, ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল দক্ষিণ পূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০কিমি/ঘণ্টা বেগে আঘাত করে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ৬মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে এবং এর ফলে প্রায় ১,৩৮,০০০ মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়।

অরক্ষিত বাঁশখালীর উপকূলের বেড়িবাঁধ : প্রলয়ঙ্করি এই ধ্বংসযজ্ঞের ৩৩ বছর পার হতে চলেছে আজ। এই ঘূর্ণিঝড়ে শুধু চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ। এখনো বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকার লোকজন বেড়িবাধের কাজ পূর্ণাঙ্গ বুঝে পায়নি। বাঁশখালীর উত্তর সীমান্ত পুকুরিয়া থেকে ছনুয়া পর্যন্ত সাগর ও নদীর প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধের অধিকাংশ এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। অরক্ষিত বেড়িবাঁধ নিয়ে উপকূলবাসীদের মধ্যে আতংক দেখা দিয়েছে। আসন্ন বর্ষায় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস হলে উপকূলের অধিকাংশ গ্রাম তলিয়ে যাবার সম্ভবনা রয়েছে। বর্ষায় অরক্ষিত বাঁধ বেয়ে বন্যার পানি ঢুকে মাছের ঘের, লবণ মাঠ, ফসলী জমিসহ ডুবে কোটি টাকার ক্ষতির আশংকা করছে উপকূলবাসী।

উপকূলবাসী অভিযোগ করে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)’র সঠিক তদারকির অভাবে গেল দুই বছরের মাথায় ২০২৪ সালে এসে নব নির্মিত বেড়িবাঁধের প্রায় ২৬ স্থানে ফাটল ও ধস দেখা দিয়েছে। জলোচ্ছ্বাস ছাড়াই সমুদ্রের স্বাভাবিক ঢেউয়ে ভেঙে গেছে সিসি ব্লক। কোথাও কোথাও বেড়ীবাঁধের প্রায় অংশ সমতলে বিলীনের পথে। উপকূলবাসীর দাবি আসন্ন বর্ষার আগে বেড়িবাঁধ সংস্কার না করলে গ্রামের পর গ্রাম

বিপর্যয়ের আশংকা করছে বাঁশখালী উপকূলের অধিবাসীরা। এ বিষয় জানতে চাইলে পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী বর্ষার আগে বরাদ্দ পাবার সুযোগ নেই।

সরেজমিন দেখা গেছে, বাঁশখালী উপকূলবাসীর জীবন রক্ষায় ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার নব নির্মিত স্থায়ী বেড়িবাঁধ জলোচ্ছ্বাস ছাড়াই ভাঙছে আর ভাঙছে। খানখানাবাদ উপকূলের কদম রসুল গ্রামে বেড়িবাঁধ জোয়ার-ভাটার স্রোতে প্রতিদিনই ভাংগনের খেলায় এখন বিশালকার রূপ নিচ্ছে। কোথাও আবার বাঁধ ধসে গেছে ভয়ানকভাবে। একই দৃশ্য খানখানাবাদের প্রেমাশিয়া, খানখানাবাদ গ্রাম, পুকুরিয়ার তেইচ্ছিপাড়া, সাধনপুরের রাতা খোর্দ, গন্ডামারার বড়ঘোনায়, শেখেরখীলের ফাঁড়ি মুখের অদূরে, ছনুয়ার ছোট ছনুয়া। উল্লেখিত স্থানগুলোর অন্তত ২৬ স্থানে নব নির্মিত বেড়িবাঁধে সিসি ব্লকে ধ্বস দেখা দিয়েছে। নিম্নমানের সামগ্রীতে নির্মিত সিসি ব্লকের সিমেন্ট উঠে গিয়ে সিসি ব্লক ভেঙে গেছে। স্থানীয়রা অভিযোগ তুলেছেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের নামে লুটপাটের কারণে অল্প সময়ে স্থায়ী বেড়িবাঁধে ফাটল ধরেছে এবং ভাঙছে। যার ফলে কোটি টাকার বেড়ীবাঁধ এখনো অধরা, স্বপ্নের মতোই।

এলাকাবাসী অভিযোগ করে বলেন, ২০১৫ সালে বাঁশখালীতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হলে কাজ শেষ হয় ২০২২ সালে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে দুর্নীতি করেছেন এ বাঁধ নির্মাণে। বেড়িবাঁধ রক্ষায় ঢালু বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত ঘাস ও গাছ লাগানোর কথা থাকলেও তা লাগানো হয়নি। ব্লক নির্মাণে নিম্নমানে পাথর, ইট, সিমেন্ট ও বালু ব্যবহার করায় কাজ বুঝিয়ে দেয়ার আগেই অধিকাংশ সিসি ব্লক ভেঙে গেছে। বিস্তীর্ণ বেড়িবাঁধ জুড়ে ভাঙা সিসি ব্লক দৃশ্যমান ও নিম্নমানের বেড়িবাঁধ দৃশ্যমান হলেও পাউবো’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোন নজর নেই। অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ। শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে উপকূলবাসীর স্বপ্নের বেড়ীবাঁধ, তবে স্বপ্ন স্বপ্নের মতোই অধরাই থেকে গেল। অতিবৃষ্টি কিংবা বর্ষার ঢলে, সমুদ্রের জোয়ারের ঢেউয়ে বিলীন হয়ে যেতে বসেছে বাঁধের অধিকাংশ পয়েন্ট। এখনো বাঁশখালী উপকূলের নিম্নাঞ্চলের মানুষ দূর্যোগকালীন সময়ে আতংকে থাকে। এ উপজেলার মানুষ এখনো প্রতি বর্ষায় নির্ঘূম রাত কাটান।

এ বিষয়ে পাউবোর উপ- বিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম পাল বলেন, বাঁশখালী উপকূলের বেড়িবাঁধের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। বেড়ীবাঁধের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তবে তা আগামী বর্ষার আগে পাবার সম্ভাবনা নেই। তবে দুর্যোগ ঠেকাতে তারা সার্বক্ষণিক বাঁশখালীকে নজরে রেখেছেন।

বিএনএ/নাবিদ

Loading


শিরোনাম বিএনএ