।। রেহেনা ইয়াছমিন ।।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে হটিয়ে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। জারি করা হয় জরুরী অবস্থা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ বেশিরভাগ শীর্ষ রাজনীতিবিদ দুর্নীতির অভিযোগে কারাবন্দী ছিলেন। এই অবস্থায় রাজনীতিকদের দৃবৃত্তায়ন ও দুর্নীতি মোকাবেলায় নোবেল বিজয়ী বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পরিচ্ছন্ন সৎ ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত একটি রাজনৈতিক দলের প্রস্তাব করেছিলেন। তার নাম রাখা হয়েছিল নাগরিক কমিটি।
এর আগে ২০০৬ সালের প্রথম দিকে অধ্যাপক রেহমান সোবহান, সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আইনবিদ কামাল হোসেন, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যসহ সুশীল সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে একটি প্রচারণায় অংশ নেন ড. ইউনূস। জাতীয় নির্বাচনে সৎ ও পরিচ্ছন্ন প্রার্থীদের জন্য সে বছরের শেষের দিকে রাজনীতিতে প্রবেশের কথা ভেবেছিলেন।
সেসময় দেশের জনগণের কাছে তার ধারণাগুলি জানিয়ে দেশের ইংরেজি জাতীয় পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টারে নাগরিকদের উদ্দেশ্যে মোট তিনটি চিঠি লিখে মতামত চেয়েছিলেন। আগ্রহী যোগ্য প্রার্থীর অভাবের কারণে তিনি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার উদ্যোগ বাতিল করে দেন এবং রাজনীতি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কিন্তু দীর্ঘ ১৭ বছর পর তিনি আবারও রাজনৈতিক বলয়ে ফিরে আসেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করে ড. ইউনূসকে সুদূর প্যারিস থেকে উড়িয়ে এনে তিন দিন পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার চেয়ারে বসান। গত সাড়ে ৪ মাস ধরে তিনি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে চায়। আর এর জন্য চাই নিজেদের একটি রাজনৈতিক দল। গত তিন মাস ধরে জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে একটি সংগঠনের কাজ করে যাচ্ছে।
কোটা বিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এবার নিজেদের অবস্থান ভোটের ময়দানে দেখতে চান। তারা নির্বাচনী লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী দুই মাসের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল।
২০০৭ সালের ড. ইউনূসের সেই নাগরিক শক্তির আদলে দলের সম্ভাব্য নাম হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে ‘জনশক্তি,’ যদিও সবার মতামতের ভিত্তিতে নাম পরিবর্তনের সম্ভাবনাও রয়েছে। ছাত্রনেতারা জানিয়েছেন, নতুন দলের মূল লক্ষ্য হবে জনগণের আস্থা অর্জন করা।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ছাত্রনেতারা বলছেন, তারা এতদিনের প্রচলিত রাজনীতির ধারা থেকে আলাদা কিছু উপস্থাপন করবেন। জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী জানিয়েছেন, এই দলটি হবে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে। এখানে সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদী কাঠামোর কোনো স্থান থাকবে না। পুরোনো সমস্যা, যেমন টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জনআকাঙ্ক্ষার বিপরীত কর্মকাণ্ড বা কোনো বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে তারা হাটবে না।
নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ক্ষমতা নয়। দেশের কল্যাণসাধন করা। যদি গণহত্যার বিচারের আগেই নির্বাচন হয়, তবে আমাদের লক্ষ্য থাকবে যে কোনোভাবে খুনিদের বিচার করা। রাজনৈতিক জোটেও যোগ দিতে পারেন নতুন রাজনৈতিক দল জনশক্তি। নাসিরুদ্দিন জানান, জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া কয়েকটি দলের সঙ্গে তাদের আলোচনা-বোঝাপড়া চলছে।
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাটাশুরে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন প্রসঙ্গে বলেছেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় স্বৈরাচারের অধীনে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং সব অপরাধী একত্র হয়ে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে বা কোনো দলকে সংগঠিত করলে তা অপরাধীদের দল হবে।
রিজভী বলেন, বাংলাদেশের জনগণ যথেষ্ট সচেতন। তারা কিন্তু উটপাখির মতো বালুর নিচে মাথা গুঁজে নেই। তিনি বলেন, ছলচাতুরী করে কোনো লাভ হবে না। অন্তর্বর্তী সরকার যে রোডম্যাপ দিয়েছে, তা প্রলম্বিত রোডম্যাপ, জনগণ তা প্রত্যাশা করেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা, মনে করেন ১৭ বছর আগে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নাগরিক শক্তি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করার চিন্তা থেকে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বিরত থাকলেও এবার তিনি ছাত্রদের সামনে নিয়ে জনশক্তি রাজনৈতিক দল গঠন করে জাতিকে নতুন পথে হাটাতে চান।
বিএনএনিউজ/ বিএম