16 C
আবহাওয়া
৮:৩২ পূর্বাহ্ণ - জানুয়ারি ২২, ২০২৫
Bnanews24.com
Home » যান্ত্রিক যুগে আন্তরিক খোরাক হারিয়ে যাচ্ছে

যান্ত্রিক যুগে আন্তরিক খোরাক হারিয়ে যাচ্ছে


ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

মানুষের জীবনের প্রধান চাহিদা শান্তি। কেউ শান্তি খুঁজে অর্থবিত্তে আর কেউ শান্তি খোঁজে মানসিক, কেউ খুঁজে শারিরীক। কিন্তু বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিশ্বে মানসিক ও শারিরীক শান্তি দিন দিন কমছে। বর্তমান ভোগের বিশ্ব। প্রতি ১০ বছরে ভোগের সামগ্রী দ্বিগুণ হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রাইভেট গাজীর সংখ্যা ৭ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। ভোগের বিশ্বে জীবনকে উপভোগ করার ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। জীবনটা ভোগ করার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা দরকার। জীবনকে উপভোগ করার জন্য টাকার দরকার হয় না। একটি কবিতা, একটি গান, একটি বই, একটি আড্ডা, চাদনী রাত, সাগর তীর, বনভূমি দৃশ্য দেখে জীবনটাকে উপভোগ করা যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সৌন্দর্য ভোগের নয়, উপভোগে’।
বাল্যকালে আমরা আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে, লাটিম খেলে যে আনন্দ পেয়েছি, সে আনন্দ আমাদের সন্তানদের নিকট নেই। কারণ নতুন নতুন এন্ড্রয়েড সেট, ল্যাপটপ,কম্পিউটারের মত শত শত ভোগের সামগ্রীপ্রতি বছর বাজারে আসছে। একজনের হাতে লেটেস্ট মডেলেরটা থাকবে আরেক জনের হাতে থাকবে না, তা তো মনোযন্ত্রণার কারণ। এই মানসিক যন্ত্রণায় মানুষ অসুখি হচ্ছে। সেরাটা পেতে আমাদের সন্তানরা অনেক ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
শারিরীক সুখের জন্য শত শত হাসপাতাল, এসি গাড়ি, বিমান, অট্টালিকা, উন্নত বিচানাসহ কত কিছুর আয়োজন দিনে দিনে বাড়ছে, কিন্তু তাতে আমরা মানসিক ভাবে কী সুখি হতে পারছি? বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতি যদি আমাদের মানসিক সুখি করতো তা হলে উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে আত্মহত্যা ও ঘুমের ওষধ সেবন দ্রুত বৃদ্ধি পেতো না। জীবন তো একটি। সবাই এই জীবনের মায়ায় বন্দী থাকতে চায়। এই জীবন একটি ওয়ানওয়ে ব্যবস্থা। আধুনিকতা কেন জীবনকে শেষ করতে আত্মহত্যার পথ গ্রহণ করছে তা ভাবার বিষয়। ১৯৫০ হতে পৃথিবী নামক গ্রহটিতে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি শুরু হয়। তখন হতে আর কমেনি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুসারে বর্তমান বিশ্বে বছরে ১৬ লক্ষ লোক আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, এই সমস্যার সামাধান চাইলে, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ ও ইন্টারন্যাটের কারণে আমরা কাছের মানুষগুলোকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি। বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে, অবসর আড্ডা-আনন্দের পরিধি সংকোচিত হচ্ছে।
অপেল কম্পিউটারের প্রধান নির্বাহী টিন কুক ঘোষণা করেছেন,’সমগ্র পৃথিবীর মানুষ চিন্তিত, রোবট মানুষের মত আচরণ করছে বলেই,কিন্তু আমি চিন্তিত মানুষ রোবটের মত আচরণ করছে বলে’। রোবট যদি মানুষের মত আচরণ করে, মানুষের আর কাজ থাকবে না। মানুষ অকেজো হয়ে যাবে। কিন্তু আমি টিম কুক চিন্তিত, মানুষ কেন রোবটের মত আচরণ করছে, মানুষ কেন যান্ত্রিক যুগে আন্তরিক খোরাক হারিয়ে ফেলবে! কেন মানুষের সাহিত্য থাকবে না, সংস্কৃতি থাকবে না, মানুষের মানবিকতার কেন মৃত্যু হবে। এটিই আজ চিন্তার প্রধান কারণ।

ক্ষমতা অর্থবিত্ত মানুষকে সুখি করতে পারে না। অসীম ক্ষমতা, অর্থবিত্ত, রূপ, আভিজাত্য ও বাগ্মীতা যদি মানুষকে সুখি করতো, রাণী ক্লিওপেট্রা আত্মহত্যা করতো না। সুখ শান্তি মনের বিষয়। সুখি হতে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। সন্তুষ্টি মানে সরব। শোকর আর সবর যার আছে সে মানসিক ভাবে সুখি। মহান আল্লাহ পাক বলেননি, আমি নামাজ আদায়কারীদের সাথে আছি, যাকাত প্রদানকারীদের সাথে আছি, হজ্বকারীদের সাথে আছি, রোজা পালনকারীদের সাথে আছি, তিনি শুধু বলেছেন, ‘ইন্নাল্লাহা মা’আস সাবিরিন’ নিশ্চয়ই আল্লাহ সবর কারীদের সাথে আছেন। বর্তমান সময়ে শোকর সবর কমে যাচ্ছে, শান্তি বিদায় নিচ্ছে। এককালে আমাদের অভাব ছিল কিন্তু অভাববোধ ছিল না। এখন আমাদের অভাব কম কিন্তু প্রচণ্ড অবাভবোধ আমাদের গ্রাস করছে। দিনে দিনে লোভের লালসা বৃদ্ধি পাচ্ছে। লোভীর লোভ শেষ হয় না। পৃথিবী নামক গ্রহটি লিখে দিলেও লোভ নিবারণ হবে না। মঙ্গলগ্রহ বিজয় করতে চাইবে। অর্থবিত্ত কবরে নেওয়া যায় না, কবরে টাকা চলে না। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘দি লাস্ট জ্যাকেট হ্যাজ নো পকেট’ শেষ কাপড়ের পকেট থাকে না। দাফনের জন্য যে কাফন পরানো হয় সে কাপড়ের পকেট নেই। তারপরও টাকার নেশায় মানুষ অমানুষ হচ্ছে। বিল গেটসের মত ধনী, পূর্ণিমার মতো সুন্দরী, জাস্টিস ট্রুডোর মতো ক্ষমতাবান ব্যক্তির যখন সংসার ভাঙ্গে তখন বুঝতে হবে জীবন সংসারে আরো কিছু দরকার হয়। যা অর্থ সৌন্দর্য ক্ষমতা দিয়ে পাওয়া যায় না।

সবাই সুখি হতে চাইলেও সুখি হতে পারে না। সুখি হওয়ার মন্ত্র জানতে হয়। আত্মকেন্দ্রীক মানুষ সুখি হতে পারে না। যারা সমাজ কল্যাণ করেন তারা মানসিক ভাবে সুখি হয়। তাদের ঘুমের ওষুধ খেয়ে হয় না,ভোগের চেয়ে ত্যাগে কী আনন্দ, যারা ত্যাগ করে না তারা জানে না। আমরা নিজেরাই আত্মকেন্দ্রীক মানুষের সংখ্যা বাড়াচ্ছি। সন্তানদের হাতে স্কুলের টিপিন দিয়ে বলছি, পুরোটাই তুমি খাবে, কাউকে দিবে না। কাউকে দিলে আমরা বকা দিই। ভাগ করে খেতে উৎসাহিত না করে উল্টো করছি। ফলে এই সব সন্তান আত্মকেন্দ্রীক হয়ে গড়ে উঠছে। সন্তানদের শিক্ষিত নয়,মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষিত মেধাবী করা সহজ কিন্তু মানবিক মানুষ করা কঠিন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষ তো সবার ঘরে জন্মায় কিন্তু মনুষ্যত্ব সবার ঘরে জন্মায় না’।মনুষ্যত্বের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে সন্তান সম্পদ পরিণত হয়।
কাউকে অসম্মান করতে শিক্ষার প্রয়োজন হয় না, সম্মানের জন্য প্রয়োজন হয় শিক্ষা। সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক হলো মা বাবা।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘কারো ভালোবাসা কঠিন নয়, কারো মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করা কঠিন’। মা বাবাই সন্তানের মনে প্রকৃত ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারেন। বাবার হাত ধরে উঠে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য সব সন্তানের হয়। কিন্তু সন্তানের হাত ধরে উঠে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য সব পিতার হয় না। যে সন্তানের মনে মা বাবা ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারেন সে সন্তানই পিতার আশীর্বাদ হয়ে উঠে। এতিমখানায় গরিবের সন্তান পাওয়া যায়,ধনির সন্তান নয়। বৃদ্ধাশ্রমে ধনী ও শিক্ষিত ‘মহান ব্যক্তি’দের মা বাবা পাওয়া যায় কিন্তু গরিবের নয়। তার কারণ খোঁজতে হবে। সন্তানের অভাব ধনের নয়, মনের। শিক্ষার নয় সুশিক্ষার। প্রকৃত শিক্ষা না পেলে সন্তান কোন দিন আত্মস্থ করতে পারে না, বাবা মায়ের জন্য ব্যয় করা এটা খরচ নয়, সৌভাগ্য। যা সব সন্তানের কপালে জোটে না। জোটে সৌভাগ্যবানদের। অশিক্ষিত মা বাবা শিক্ষার মর্ম উপলব্ধি করে সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলে। আর সে শিক্ষিত সন্তান মা বাবার মর্যাদা বুঝে না। সন্তানকে এই ধরনের শিক্ষিত না করে মুর্খ রাখা অনেক ভালো। মা বাবা সন্তান ও নিজের সুখের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। সুখ দুই বর্ণের ছোট একটি শব্দ। সে শব্দটি খোঁজতে সারাজীবন সংগ্রাম করতে হয়। কেউ এই সুখের স্পর্শ পায় আর কেউ পায় না।

দুনিয়ার মধ্যে যত সম্পদ আছে, সবচেয়ে বড় সম্পদ আমাদের সন্তান। সম্পদের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সন্তানের প্রকৃত শিক্ষা-চিকিৎসার দিকে দৃষ্টি দেওয়া বুদ্ধিমানে কাজ। আজকে সম্পদ বা অর্থ না থাকলে ব্যর্থ ভাবে। তাই অর্থের পিছনে ম্যারাথন দৌড়তে গিয়ে কত শত পরিবার নষ্ট হয়ে গেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। সবকিছু থাকার পরও সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে না পেরে অনেক সফল মানুষ অশ্রু বিসর্জন দিতে দেখেছি। চোখের জল ফেলার সময়টা কঠিন, সমাজ হতে চোখের জল গোপন করার সময়টা আরো বড় কঠিন। সব কান্নায় বেদনা থাকে না। এক এক কান্নার এক এক অর্থ। কান্নার ভাষা বুঝাও কঠিন। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, কান্নায় চোখের প্রথম ফোঁটা জল ডান চোখে দিয়ে গড়ালে ঐ কান্নায় থাকে আনন্দ। আর বাম চোখে গড়ালে থাকে বেদনা। কোন কান্না ব্যথা দেয়, আর কোন কান্না জীবনটাই বদলে দেয়। আহত শরীর নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে আহত মন নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক কঠিন। প্রত্যেক মানুষের কষ্টের একটা সময় থাকে, আপন লোকের কষ্টের ভাব বহন করা কঠিন। কষ্টের সময়টা সারাজীবন থাকে না কিন্তু কষ্টের সময় মানুষের খারাপ ব্যবহার সারাজীবন মনে থাকে। সব সময় সূর্য মাথার উপর থাকে না। সূর্য অস্ত যায়, আবার উদিত হয়।

ড. আল্লামা ইকবাল বলেছেন, রাত যত গভীর গহীন হোক, প্রভাতের সূচনা অনিবার্য। কবি শেলী বলেছেন, ‘শীত যখন এসেছে বসন্ত কী আর দূরে থাকতে পারে’। দুঃখের পর মানুষের সুখ আসবেই। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?/ তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে’। জীবনের জাগরণ ঘটাতে না পারলে, নিজের মধ্যে সুপ্ত শক্তির বিকাশ করতে না পারলে জীবনের প্রভাত আলো উদিত হবে কী ভাবে!আত্মশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারলে বিজয়ী হবেই। পরাজয় বলতে কিছু নেই, জিতবে না হয় শিকবে। সফল হলে পৃথিবী তোমাকে চিনবে আর ব্যর্থ হলে তুমিই পৃথিবীকে চিনবে। জীবনে স্বপ্ন থাকতে হয়, স্বপ্নকে ভালোও বাসতে হয়। ভালোবাসার স্বপ্নের মৃত্যু নেই। শীর্ষ ধনকুবের ওয়ারেন বাফেট সফলতার দুটি সূত্র প্রদান করেছে। প্রথম সূত্র: কখনো হার মানা যাবে না। দ্বিতীয় সূত্র: প্রথম সূত্রটা কখনো ভোলা যাবেনা না’। আমাদের সন্তান এই সূত্র অনুসরণ করলে সফলতা দরজায় কড়া নাড়বে।

লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক

Loading


শিরোনাম বিএনএ