বিএনএ, ঢাকা : বিদ্যমান কারা আইন আধুনিক ও সময়োপযোগী করতে সরকার গুরুত্বের সাথে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। বুধবার(১৭ ফেব্রুয়ারী) পুরান ঢাকার কারা কনভেনশন সেন্টারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কারামুক্ত বন্দিদের মাঝে জীবিকায়ন সামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা বলেন।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুনের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ অনুবিভাগ) ড. তরুণ কান্তি শিকদার, বাংলাদেশস্থ জার্মান রাষ্ট্রদূত পিটার ফারেন হোল্টজ, বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন, অতিরিক্তি কারা মহাপরিদর্শক কর্ণেল আবরার হোসেন, রুল অব ল প্রোগ্রামের প্রধান প্রমিতা সেনগুপ্ত, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের সভাপতি রফিকুল আলম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ।
অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত বর্তমান সরকার কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে রূপান্তরে বদ্ধ পরিকর। পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে কারাগারের পরিবেশ উন্নয়নে সরকার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনায় কারাগারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বন্দিদের জন্য নানারকম সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতকরণ, বন্দিদের সঙ্গে কারা প্রশাসন ও কারারক্ষীদের মানবিক আচরণসহ আরও অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা কারা প্রশাসন পরিচালনা করছি। এছাড়াও কারাগারের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকার বিদ্যমান কারা আইন সংশোধন করে আধুনিক ও সময়োপযোগি আইন হিসেবে প্রণয়নের উদ্যোগ হিসেবে কারা অধিদপ্তর এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশ প্রিজন্স এন্ড কারেকশনাল সার্ভিসেস এ্যাক্ট প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। এ আইন প্রণয়নের মূল লক্ষ্য হবে কারাগারগুলোকে সংশোধনাগার ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে রূপান্তর করা।
তিনি বলেন, এক সময় কারাগারে কয়েদিদের মানবেতর জীবন-যাপন করতে হতো। সমাজের সংস্কার নিয়ে আসা অত্যন্ত প্রয়োজন। এই সংস্কারের জন্য মানুষের মানসিকতায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা দরকার। কারাগারে থেকে যেন বড় অপরাধী তৈরি না হয়, সেদিকে সর্তক থাকতে হবে। অনেক সময় ছোটখাটো অপরাধে কারাগারে ঢুকে বড়-বড় অপরাধীদের সঙ্গে মিশে বন্দিরা আরও বড় অপরাধী হয়ে বের হয়। সেটা যেন না হতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারাবন্দিদের প্রশিক্ষণ ও উৎপাদনমুখী কাজের মধ্যদিয়ে অপরাধ প্রবণতা থেকে বের করে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে হবে। কারাগারে উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে বন্দিদের আরও বেশী সম্পৃক্ত করতে হবে। মজুরি জমিয়ে রাখলে কারাজীবন শেষে সেই অর্থ পরিবারে নিয়ে যেন তারা কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। অপরাধীদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা আমাদের সবার দায়িত্ব।
মন্ত্রী আরও বলেন, কারাগারকে বন্দিদের জন্য সংশোধনগার হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। এরই ধারাবাহিকতায় কারা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য রাজশাহীতে গড়ে উঠছে কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি। অবকাঠামোগত উন্নয়নের অংশ হিসেবে সিলেট, কিশােরগঞ্জ, ফেনী, পিরােজপুর ও মাদারীপুর কারাগার নবনির্মিত স্থাপনায় স্থানান্তরিত হয়েছে। ফলে কারাগারের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ হাজার ৯৫০ জনেরও অধিক।
গত বছরের শেষের দিকে নারী বন্দীদের জন্য আধুনিক সুবিধা নিয়ে কেরাণীগঞ্জে উদ্বোধন হয়েছে মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার। কারাগারটিতে কিশোরীদের জন্য রয়েছে আলাদা ভবন। যে বন্দীদের সন্তান রয়েছে তাদের জন্য রয়েছে ডে কেয়ার সেন্টার, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, পাঠাগার, ওয়াশিং প্ল্যান্ট এবং মানসিকভাবে অসুস্থ বন্দীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা। বন্দিদের দীর্ঘদিনের সকালের নাস্তায়া শুধুমাত্র রুটি ও গুড়ের পরিবর্তে সপ্তাহের ৪ দিন সবজি-রুটি, ২দিন খিচুড়ি ও ১দিন হালুয়া-রুটি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন আমল থেকে প্রচলিত কারাগারে আটক বন্দিদের প্রাপ্য ৩টি কম্বলের মধ্যে ১টি কম্বলের পরিবর্তে ১টি শিমুল তুলার বালিশ সরবরাহের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সার্বক্ষনিক যোগাযোগ স্থাপন এবং বন্দির মানষিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতে স্বজনদের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কারা অধিদপ্তর আয়োজিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কারামুক্ত বন্দিদের জীবিকায়ন সামগ্রী বিতরণ কর্মসূচীটি একটি প্রশংনীয় উদ্যোগ। তবে এটি সামগ্রী বিতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আধুনিক কারা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দির সংশোধন ও পূর্নবাসনে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেনটেন্স প্ল্যানিং বা সাজা পরিকল্পনা উদ্যোগটি বাস্তবায়নে জার্মান সরকার ও বৃটিশ সরকারের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখার জন্য অনুরোধ করছি।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, বন্দিদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনসহ যথাযথ আইনের পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। এরই অংশ হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কারামুক্ত বন্দিদের মাঝে জীবিকায়ন সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।
জার্মান রাষ্ট্রদূত বলেন, উদ্যোগটি বাংলাদেশ কারা বিভাগের সংশোধনাগারের পরিণত হবার পথে একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। কারাভ্যন্তর বন্দিদের যথাযথ প্রশিক্ষণের বিষয়ে আমরা গুরুত্বরে সাথে সহযোগিতা প্রদান করছি। প্রাতিষ্ঠানিক অংশীদারীত্ব কারাভ্যন্তরে ও সমাজে কারাবন্দিদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে সফল করতে পারে। জার্মানী এই সহযোগিতায় যুক্তরাজ্য সরকারের পাশে থাকতে পেরে আনন্দিত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ আইন সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে আমরা বাংলাদেশ সরকারের পাশে আছি।
ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেন, কারাবন্দি এবং তাদের পরিবরের সদস্য যারা যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও বাংলাদেশের মধ্যে অংশীদারিত্ব থেকে উপকৃত হচ্ছেন তাদের জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনাকে উদযাপন করছে। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম সহযোগী যুক্তরাজ্য সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার বিষয়ক কাজে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমি আনন্দিত যে সমাজে নিজেদের টেকসইভাবে পুনর্বাসিত করতে অনেক মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিরা এই যৌথ প্রকল্পের মাধ্যমে জীবন-জীবিকার সহায়তা পাবে।
উল্লেখ্য, করোনাকালীন গৃহীত সহায়তা কার্যক্রমের অংশ হিসাবে কারা অধিদপ্তর ও জিআইজেড এর প্রকল্প বাস্তবায়নকারি সংস্থা ঢাকা আহছানিয়া মিশনের যৌথ উদ্যোগে সেলাই মেশিন,ইলেক্ট্রনিক টুলবক্স, ভাসমান টি স্টলের জন্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন জীবিকায়ন সামগ্রী নিয়মিতভাবে বিতরণ করা হয়। রুল অব ল’ প্রোগ্রাম বাংলাদেশ সরকার এবং ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানীর একটি যৌথ উদ্যোগ। সুরক্ষা সেবা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথভাবে এ প্রোগ্রামটি বাস্তবায়নে কারা অধিদপ্তরকে কারিগরি সহায়তা করছে জিআইজেড। আর অর্থ সহায়তা করছে জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিএমজেড) এবং ব্রিটিশ সরকারের ফরেন, কমনওয়েলথ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও)। বিচার ব্যবস্থা এবং কারাগার সংস্কারের বিশেষ করে বিচারাধীন মামলার দ্রæত নিষ্পত্তি, কারাগারে বন্দিসংখ্যা হ্রাস করে ন্যায়বিচারে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের ২৬টি জেলায় সহযোগি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বিএনএ/এসকে, ওজি