।। ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী।।
জীবনের বসন্ত ফিরে আসেনা। দুনিয়ার সমস্ত আয়োজন, সমস্ত ক্ষমতা, সকল অর্থবিত্ত আমাদের জীবনের বসন্ত ফিরিয়ে আনতে পারে না।মানুষ যত বড় বীর হোক কোথাও পরাজিত না হলেও মৃত্যুর নিকট পরাজিত হতে হয়। বিজ্ঞান প্রযুক্তি অসম্ভবকে সম্ভব করছে। অনেক কিছু করা সম্ভব হলেও মানুষ মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারে নি। এই ক্ষমতা মানুষের নেই। আপনি যত বড় শক্তিশালী মানুষই হোন, যত ক্ষমতাধর ব্যক্তি হোন, আপনার ক্ষমতা মৃত্যুর নিকট অসহায়।
হৃদরোগের বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. শফিকুল ইসলাম লিটু হাসতে হাসতে শত শত রোগীর হার্ড অপারেশন ও রিং বসাতেন। জীবনে চিন্তাই করেননি তিনি হৃদরোগে মারা যাবেন। হঠাৎ একদিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। রিং বসানোর সুযোগটাই পেলেন না। এই হলো মৃত্যুর শিক্ষা।
মৃত্যু একটি ওয়ানওয়ে ব্যবস্থা, একবার এই রাস্তা অতিক্রম করলে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। মানুষ মরণশীল, এটি কোন প্রবাদ নয়, এটি আল্লাহর বিধান যা প্রতিদিন প্রয়োগ হতে দেখি চরম সত্য হিসেবে। যে বিধান সমগ্র দুনিয়ার মানুষ একত্রিত হয়েও বাতিল করতে পারবে না।
দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে। ইতালিয়ান টাইলস, জার্মানীর ফিটিংস দিয়ে যে বাথরুম তৈরি করেছেন সেই বাথরুমে আপনার শেষ গোসলটি হবে না। উর্দু ভাষায় একটি কথা আছে, ‘জিন্দেগি মে না জানে কোনছে বাত আখের হোতা হ্যায়, কোনছে রাত আখের হোতা হ্যায়’। আমরা জানি না জীবনের কোন কথাটি শেষ কথা, কোন রাতটি শেষ রাত। মৃত্যু কাউকে নোটিশ দিয়ে আসে না। মৃত্যুর স্থান কাল কারো জানা নেই।
হযরত সোলাইমান (আ.)’র এক উম্মাত থলে নিয়ে বাজারে ঘুরছেন। এমন সময় এক লোক চোখ বড় করে তার দিকে তাকায়। লোকটি জানতে চান, আপনি চোখ বড় করে আমার দিকে কেন এ ভাবে তাকাচ্ছেন? সে বললো, আমি মালাকুল মউত। তোমার প্রাণ সংহার করতে এসেছি। লোকটি বাজারের থলে ফেলে দৌড়ে হযরত সোলাইমান (আ.)’র দরবারে হাজির হয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করে হযরত সোলাইমান (আ.) নিকট প্রার্থনা করলেন, আপনার যে বিশেষ আসন আছে, যে আসন দ্বারা মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূরে নিয়ে যেতে পারে,সে আসনে করে আমাকে হাজার মাইল দূরের কোন দ্বীপে পাঠিয়ে দিন।যেন মালকুল মাউত সেখানে গিয়ে আমার প্রাণবধ করতে না পারেন। হযরত সোলাইমান (আ.) তাই করলেন। সাথে সাথে মালাকুল মাউত হযরত সোলাইমান (আ.)’র দরবারে হাজির হয়ে বললেন, হে আল্লাহর নবী। আমি এক সমস্যায় পড়েছি। আপনার এক উম্মাতের মৃত্যু লেখা আছে হাজার মাইল দূরে এক দ্বীপে। সে লোকটির হায়াত শেষ। কিছুক্ষণ পর সে দ্বীপে তার প্রাণ সংহারের নির্দেশ রয়েছে। এই লোক দেখছি বাজারে ঘুরছে। আমি ভাবছি এই অল্প সময়ের মধ্যে এই লোক হাজার মাইল দূরে যাবে কী ভাবে। অথচ আমি তার প্রাণবধ করতে প্রস্তুত।
হযরত সোলাইমান (আ.) বললেন, তুমি সে দ্বীপে যাও, সেখানে তাকে আমি পাঠিয়ে দিয়েছি। যে মুহূর্তে,যে স্থানে,যার মৃত্যু লেখা আছে সেখানেই তার মৃত্যু হবে। ব্যতিক্রম হবে না।
আমরা এক সময় ছিলাম না, এখন আছি, আরেক সময় থাকবো না। এটি চিরন্তন সত্য। দুনিয়ার সবকিছুর জন্য আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করি। বিয়ের জন্য,ক্যারিয়ারের জন্য, চাকুরীর জন্য, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিই, শুধু প্রস্তুতি থাকে না আমাদের মৃত্যুর জন্য। বড় বিস্ময়কর বিষয় হলো, মানুষ জানে, মানুষ মরে যাবে তা মানুষের মনেই থাকে না। যে দিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আরেকটা নিঃশ্বাস নিতে পারবে না, সেদিন বুঝবে জীবনের কত মূল্য। কিন্তু তখন কিছুই করার থাকে না। সুস্থতা মহান আল্লাহর কী নেয়ামত তা যতক্ষণ অসুস্থতায় না পড়ি ততক্ষণ বুঝতে পারি না। জীবনের মূল্য কত তা মৃত্যুর আগে বুঝতে পারবো না। আমাদের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে মৃত্যু নিয়ে নয়। কারণ ইহকালের মধ্যে নিহিত রয়েছে পরকালের মুক্তি। মানুষের জন্মের পর আজান আর ইকামত দেওয়া হয়,আর মৃত্যুর পর হয় নামাজ (জানাজা)। আজান ইকামতের পর নামাজের নিয়তের পূর্ব সামান্য সময়টাই আমাদের জীবন। এই সংক্ষিপ্ত জীবনে সুপ্ত রয়েছে পরকালে সফল ‘মাবাহেল’ বা স্টেশন,যেমন: মৃত্যু, কবরের সওয়াল জবাব, বরজখ, হাশর, পুলসিরাত,জান্নাত জাহান্নাম। আমরা দুনিয়ায় বসে আখিরাতের কথা ভুলে যাই। এই ক্ষণস্থায়ী জীবন পেরিয়ে কখন যে চিরস্থায়ী জীবনে চলে যাবো তা বুঝতেই পারবো না।
দার্শনিক ইমাম গাযযালী (রহ.) বলেছেন, ‘হে মানুষ তোমার জন্য যে কাফনের কাপড় কাটা হবে সেটা এখন বাজারে অথচ তুমি বেখবর’।
মানুষ মৃত্যু হতে বাঁচতে শত চেষ্টা করে কিন্তু বাঁচতে পারে না, মানুষ চাইলে জাহান্নাম হতে বাঁচতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জাহান্নাম হতে বাঁচার চেষ্টা করে না।মৃত্যু হতে বাঁচতে চেষ্টা করে।জীবন সফল করতে হলে আমাদের তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। কোথা হতে এসেছি, কেন এসেছি এবং কোথায় যাবে। এই তিন প্রশ্নের উত্তর জানতে লক্ষ লক্ষ নবী রাসুল (দ.) আগমন করেছেন। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা চেষ্টা করি না।
আমরা যখন একটি লাশ সামনে দেখি এবং জানাজার নামাজে উপস্থিত হই তখন সবাই বলাবলি করি, হায়রে কী আছে দুইদিনের দুনিয়ায়! লাশের আড়ালে গেলেই বাটপারি করি, চুরি করি, ঘুষ খাই, মিথ্যা কথা বলি। আমরা এই লাশগুলো হতে কোন শিক্ষা গ্রহণ করি না।
জ্বীন জাতির দ্বারা হযরত সোলাইমান (আ.) জেরুজালেমে মসজিদে আকসা নির্মাণ করেছিলেন। নির্মাণ কালে আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশ প্রদান করা হলো, তাঁর প্রাণ তুলে নেওয়ার।আজরাইল (আ.) আসলেন তাঁর নিকট। হযরত সোলাইমান (আ.) একটি লাঠির ওপর ভর দিয়ে নির্মাণ কাজ করিদর্শন করেছিলেন। যখন হযরত সোলাইমান (আ.)’র রুহ কবজ করতে চাইলেন, তখন তিনি আল্লাহর ঘরটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে কিছু সময় চাইলেন। কারণ এই অবস্থায় তাঁর ইন্তেকাল হলে জ্বীনরা কাজ বন্ধ করে দিবে। নির্ধারিত সময় হতে আল্লাহর ঘর নির্মাণের জন্য এক মিনিট সময় বেশী দিলেন না। সময় যখন ফুরিয়ে যাবে তখন মৃত্যু হাজির হবে। তখন কোন ভালো কাজের জন্যও মৃত্যু অপেক্ষা করবে না।এমন কী মসজিদ নির্মাণের জন্যও অপেক্ষা করবে না।
হযরত সোলাইমান (আ.) ইন্তেকালের পরও লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু জ্বীনরা তা বুঝতে পারে নি। যেদিন জ্বীনরা সমজিদের কাজ শেষ করে সেদিন সোলাইমান (আ.)’র লাঠিটি উই ফোকার কারণে ভেঙ্গে পড়ে। আল্লাহর কাজ আল্লাহই করবেন কিন্তু মৃত্যুকে লঙ্ঘন করে নয়।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, আল-লাজি-খানাকাল মাউতা ওয়াল হায়াত লিয়াবলুয়াকুম’ অর্থাৎ আমি মৃত্যু ও জীবন দিয়েছি পরীক্ষা করার জন্য’। এই আয়াতে জীবনের আগে মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছেন। কারণ আমাদের জন্ম হয়েছে মৃত্যুবরণ করার জন্য। মানুষ হায়াতের মধ্যে থাকলে মৃত্যুর কথা ভুলে যায়। জীবনকে মৃত্যুর প্রস্তুতির জন্য ব্যবহার করা উচিৎ। মৃত্যুর প্রস্তুতির কথা ভুলে যে দুনিয়া নিয়ে আমরা ব্যস্ত আছি, সে দুনিয়া কোন
কাজে আসবে না। দুনিয়ার অঢেল সম্পদ আমাদের বাঁচাতে পারবে না।
দুনিয়ার অন্যতম সেরা ধনী, এ্যাপেল কম্পিউটারের মালিক প্রযুক্তি উদ্ভাবক স্টিভ জবস ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু শয্যায় বলেছিলেন, যদিও আমি হাজার হাজার কোটি ডলারের মালিক, অথচ আমার সব সম্পদ মৃত্যুদেবতার হাতে অর্পণ করেও আরেকটি রাত বেশি বাঁচার সুযোগ পাবো না। অর্থবিত্ত মানুষের হায়াতে জিন্দেগী দীর্ঘায়িত করতে পারে না। মহান আল্লাহ পাক মানুষকে অনেক কিছু দান করেছেন, কিন্তু অমরত্ব দান করেননি। কত বড় বড় মহারাজ, ধর্নাঢ্য ব্যক্তি কবরে শুয়ে আছেন তার নেই ইয়ত্তা। দুনিয়ার বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান, পদ পদবীধারী মানুষের দিকে না থাকিয়ে কবরের দিকে তাকান কারণ বড় বড় রাজা মহারাজা শিল্পপতি কবরস্থানে শুয়ে আছে।
বিশ্ববিজেতা বীর আলেকজান্ডার তাঁর কবরের এফিটাফে লেখে দিতে বলে গেছেন, ‘এই খানে, এই মাটির ঢিবি যাকে ডেকে রেখেছে, পৃথিবীটা তাঁর নিকট বেশী বড় ছিল না।’ এসব ক্ষমতাবান মানুষের কথাগুলো যদি ধারণ করতে পারি তা হলে আমাদের কোন অন্যায় কাজ করা সম্ভব হবে না।
লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক