বিএনএ, ঢাকা: গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে। যা গত ৫ মাসেও স্বাভাবিক হয়নি। এই সময়ে দুই দেশের সরকার নিজেদের মধ্যে ‘বন্ধুপ্রতিম’ ব্যবহার করেনি, বরং উল্টো ‘শত্রু হিসাবে আচরণ করেছে। তবে নতুন বছরের শুরুতে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ তাদের মিত্র দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষপটে এবার দু’দেশের সর্ম্পকে নাটকীয় উন্নতি হতে যাচ্ছে।
দিল্লী স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, ঢাকার সঙ্গে সর্ম্পক স্বাভাবিক হবে, তবে তা পুরোপুরি ‘শর্তাধীন’ – অর্থাৎ ভারতের দেওয়া বিশেষ কয়েকটি শর্ত পূরণ না হলে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দিল্লি খুব একটা গরজ দেখাবে না।

সর্ম্পক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে দিল্লীর শর্ত হচ্ছে ‘হারিয়ে যাওয়া ভাই’টি কোন অবস্থাতেই আগের অবস্থানে ফিরতে পারবে না। অর্থাৎ পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের গলায় গলায় ভাব ও সখ্যতা কমাতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশে হিন্দু তথা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা। দিল্লির শর্তের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অন্তর্ভুক্ত করার মতো অতি স্পর্শকাতর বিষয়ও রয়েছে। এছাড়া সর্ম্পক আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিতে সামরিক বা নিরাপত্তাগত স্বার্থের দিকটিও অবশ্যই গুরুত্ব দিচ্ছে দুই দেশ।
সম্প্রতি বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর প্রধান কিংবা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যে ধরনের বার্তা এসেছে, সেটাকেও দিল্লি বেশ ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
কুটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করছে, ভারত ও বাংলাদেশকে যে পরস্পরের স্বার্থেই নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক, স্ট্র্যাটেজিক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ‘মোটামুটি একটা সুসম্পর্ক’ রেখে চলতে হবে, এই উপলব্ধিটা ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসছে এবং তার রাস্তাটা খুঁজে বের করারও চেষ্টা চলছে।
দিল্লিতে শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যে ভারত-বিরোধী ‘রেটোরিক’ থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে এটি একটি ভাল লক্ষণ, যা সুস্থ ও স্বাভাবিক সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করতে পারে।
প্রশ্ন উঠেছে, ভারতের সাউথ ব্লক ঠিক কী ধরনের বাংলাদেশ দেখতে চায়? গত ৩ জানুয়ারি দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিং-এ মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ভারত একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশকে সমর্থন করে।”
রণধীর জয়সওয়াল আরও বলেছেন, আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়তে চাই, যা হতে হবে পারস্পরিক আস্থা, মর্যাদা, স্বার্থ ও একে অপরের উদ্বেগগুলো নিয়ে সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে।”
জযসওয়ালের এই বক্তব্যে নতুন দু’টি শব্দ রয়েছে, তা হচ্ছে– গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।
বাংলাদেশ দ্রুত গণতান্ত্রিক পরম্পরায় ফিরুক এবং মানুষের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার ক্ষমতায় আসুক, প্রথম শব্দটির মধ্য দিয়ে ভারত সেটাই বোঝাতে চেয়েছে বলে দিল্লিতে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আর ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ কথাটার মধ্য দিয়ে সে দেশের সমাজজীবনে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং রাজনীতিতে সব ধরনের শক্তিকে ঠাঁই দেওয়া, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কথাই বলতে চাওয়া হয়েছে বলে তারা ব্যাখ্যা করছেন।
কিন্তু নতুন দু’টো শর্ত যোগ করার চেয়েও যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল, ৫ আগস্টের পর এই প্রথম ভারত প্রকাশ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ‘ইতিবাচক ও গঠনমূলক’ সম্পর্ক গড়ে তোলার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে।
এক সময় ঢাকায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ভিনা সিক্রি মনে করেন, ভারত যে বাংলাদেশের সঙ্গে সহজ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক চায় এর মধ্যে কোনও ভুল নেই। গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে ভারত ঠিক এই বার্তাই দিয়েছে বলে তিনি মনে করছেন।
“তবে এখানে কয়েকটি ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ আছে। পাকিস্তান যেভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চাইছে সেটা ভারতের জন্য কিন্তু একটা ‘রিয়াল’ সিকিওরিটি থ্রেট।
“বাংলাদেশের মাটিকে পাকিস্তান যে কোনওভাবে ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থের বিরুদ্ধে বা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে ব্যবহার করবে না, সেটা নিয়ে শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিত হতে পারলে তবেই ভারত এই সম্পর্ক নিয়ে এগোতে পারবে”, বলেন ভিনা সিক্রি। এর পাশাপাশি ভারত আরও দুটো ‘শর্তে’র ওপর জোর দিতে চাইবে বলেও তার পর্যবেক্ষণ।
“যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজনের ওপর ভারত জোর দেবে। শুধু তাই নয়, সে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হতে হবে, এবং তাতে সব দল ও মতাবলম্বীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।” বলেন, ভিনা সিক্রি।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে বহু বছর ধরে গবেষণা করছেন ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত। তিনি ভারত-বাংলাদেশে বিরাজমান সর্ম্পক চট-জলদি নাটকীয় উন্নতি হবে বলে মনে করেন না।
তার শঙ্কা, বাংলাদেশ যদি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ইস্যুর নিষ্পত্তি করতে না পারে, তাহলে ভারত হয়তো আবার বেঁকে বসবে এবং অসহযোগিতার রাস্তায় হাঁটবে”।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ড. ইউনূস সরকারের আমলে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের উত্থান ও আস্ফালনকে প্রতিবেশি দেশ হিসাবে হুমকি মনে করছে। যা সম্প্রতি ভারত সফরে আসা মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানকে তা জানিয়ে দিয়েছেন। জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাউথ ব্লক রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতা, বিদ্রোহী আরাকান আর্মির ভূমিকার বিষয়, চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ সর্ম্পক নিয়েও কথা হয়।
সংশ্লিষ্ট কুটনৈতিক সূত্র জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্টের দূত হিসাবে ভারত সফরকারী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংশ্লিষ্টদের বিশেষ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘সেইফ এক্সিট’ চেয়েছেন! তবে দিল্লী পরিস্কার বলে দিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণই নেবে। অর্থাৎ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের দিকে ইঙ্গিত করেছে ভারত।
প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আগেও ছিল, এখনো আছে। তার প্রমাণ মিলে ড. ইউনূস সরকার সম্প্রতি শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো ‘কূটনৈতিক নোট’কে আমলে নেয়নি। বরং তাকে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ভারতের দিক থেকে ধীরে ধীরে হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে সার্বিক সম্পর্ক সহজ করার একটা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, যদিও সেটার পরিণতি সম্ভবত নির্ভর করবে বাংলাদেশের মনোভাব এবং আগামী কয়েকমাসের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নতুন ভূ-রাজনীতির দিকদর্শনের ওপর।
বিএনএনিউজ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ বিএম