Home » ফারুকীর ‘শনিবার বিকাল’কে ভয় পেয়েছিলেন হাসিনা !
ফারুকীর ‘শনিবার বিকাল’কে ভয় পেয়েছিলেন হাসিনা !
মনে পড়ে, সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনির কথা? ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আততায়ীর হাতে খুন হন এ সাংবাদিক দম্পতি। নিজ বাসায় নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে ১২টি বছর! ১১১ বার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।
সর্বশেষ গত ৪ঠা আগস্ট ছিল মামলা প্রতিবেদন দাখিলের নির্ধারিত তারিখ। কিন্তু কার্ফ্যু থাকায় সেদিন আদালত বসেনি। এক কথায় ১২ বছরেও সাগর রুনি হত্যার রহস্য উৎঘাটন করা যায়নি, বা করতে দেওয়া হয়নি । যা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিতাড়িত শেখ হাসিনা সরকারের অনেক ব্যর্থতার মধ্যে অন্যতম।
সাগর রুনি দম্পতির একমাত্র সন্তান ‘মেঘ’ গত ১২ বছরে অনেক বড়ো হয়েছে, ভাল-মন্দ বুঝতে শিখেছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর উগ্র মৌলবাদীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি পরিষ্কারে ব্যস্ত সময় পার করছেন মেঘ! অথচ বঙ্গবন্ধু কন্যা ১২ বছরও তার বাবা-মায়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার দুরে থাক হত্যার রহস্যটাও বের করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনির হত্যাকান্ডকে নিয়ে রায়হান রাফী নির্মাণ করেছেন ‘অমীমাংসিত’ নামে একটি সিনেমা। ছবিটির মুখ্য চরিত্রে আছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ ও তানজিকা আমিন। সিনেমাটি মাত্র তিন মাস আগেই ‘প্রদর্শন উপযোগী’ নয় বলে সিদ্ধান্ত জানায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। অজানা কারণে ‘অমীমাংসিত সিনেমা এখনো অন্ধকারে। এটি ছিল শেখ হাসিনার শাসনামলে সিনেমার কফিনে মারা সর্বশেষ পেরেক। এর আগে ৬টি সিনেমাকে মুক্তি দেয়নি শেখ হাসিনা সরকার। আজকের প্রতিবেদনে সেই ৬ সিনেমার গল্পই তুলে ধরবো।
শেখ হাসিনার আমলে সেন্সরবোর্ডের ইতিহাসে আটকে থাকা অন্যতম আলোচিত সিনেমা ‘শনিবার বিকাল’। এর প্রেক্ষাপট ছিলো হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা এবং এটি নির্মাণ করেছেন বিপ্লবী কণ্ঠ মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। ২০১৯ সালে ছবিটি ছাড়পত্রের জন্য জমা দিয়েছেন মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। এই ছবিটির ছাড়পত্রের জন্য নানান মাধ্যমে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ হয়েছে সরকারের প্রতি। কিন্তু মুক্তি পায়নি শনিবার বিকাল।২০১৬ সালে রাজধানীর গুলশানে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ছায়া অবলম্বনে ‘শনিবার বিকাল’। এতে অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা, জাহিদ হাসান, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ইয়াদ হুরানি, নাদের চৌধুরী, ইরেশ যাকের, ইন্তেখাব দিনারসহ অনেকে।
‘মেকাপ’এটি নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার আলোকে তৈরি সিনেমা নয়। তবে এতে গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের ভেতরের গল্প লুকিয়ে থাকার কথা । যে গল্পে রয়েছে রাজনীতিরও খেলা। যথারীতি ছবিটি সবাইকে অবাক করে দিয়ে আটকে গেলো সেন্সর বোর্ডে। ২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি আপিল বিভাগে সর্বশেষ শুনানি হয়।
তাতে আপিল বোর্ড জানায়, ‘সিনেমাটি খুব দুর্বল নির্মাণ, দুর্বল চিত্রনাট্য, প্রদর্শনের অযোগ্য।’ সিনেমাটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছেন তারিক আনাম খান, রোশান, সাইফ চন্দন, কাজী উজ্জ্বল, পায়েল মুখার্জি ও বিশ্বনাথ।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজার বিভীষিকাময় ধ্বসের ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘রানা প্লাজা’। ছবিতে অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরীমণি। এটিই তার প্রথম সিনেমা। এতে তার বিপরীতে আছেন সায়মন সাদিক। ছবিটি প্রযোজনা করেছেন শামীমা আক্তার।
কয়েক দফা সেন্সর বোর্ড ও আইন আদালতের জটিলতা পেরিয়ে মুক্তির জন্য প্রস্তুত ছিল সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনা নিয়ে নির্মিত রানা প্লাজা। এটি নির্মান করেন পরিচালক নজরুল ইসলাম। ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মুক্তির পুরোপুরি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, আগের দিন সন্ধ্যায় পরিচালক জানতে পারেন, ছবির মুক্তিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট। দেশে-বিদেশের প্রেক্ষাগৃহ বা অন্য যেকোনো মাধ্যমেও ছবিটি দেখানো যাবে না। দীর্ঘ ৯ বছরে ছবিটি মুক্তি পায়নি।
চাকমা ভাষায় নির্মিত ‘আমার বাইসাইকেল – মর থেংগারি’ বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা। অং রাখাইন পরিচালিত ছবিটি অন্ধকারে পড়ে থাকার বয়স এখন ৯ বছর। ২০১৫ সালের মে মাসে সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডে জমা দিয়েছেন অং। কিন্তু ৯ বছর ধরে ছাড়পত্র মেলেনি মাত্র ৬৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই বিশেষ ছবিটির। ৬৪ মিনিটের ছবি থেকে ২৫ মিনিট কেটে ফেলতে বলেছে সেন্সর বোর্ড! তবেই মিলবে ছাড়পত্র। নির্মাতার প্রশ্ন, তাহলে সিনেমার আর থাকলো কি? নতুন সরকারও অং রাখাইনের সিনেমাটি মুক্তি দিবে কীনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে নির্মাতার। কারণ এই সিনেমায় রয়েছে সেনাবাহিনীর কিছু বিষয়। ‘মাই বাইসাইকেল’-এর বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন কামাল মনি চাকমা, ইন্দিরা চাকমা, ইউ চিং হলা রাখাইন, বিনাই কান্তি চাকমা, আনন্দ চাকমা, সুভাষ চাকমা, জোরাদান চাকমা।
১৫ বছর আগে সরকারি অনুদানে নির্মিত সিনেমা ‘নমুনা’ আটকে আছে এখনও। স্থপতি ও চলচ্চিত্র পরিচালক এনামুল করিম নির্ঝরের দ্বিতীয় নির্মাণ ছিল এটি। বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে।
এই সিনেমায় হাসিনা-খালেদার নেতিবাচক রাজনৈতিক চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এক কথায় ছবিটি ওয়ান ইলেভেনের মাইনাস টু ফর্মুলারও প্রতিচ্ছবি। ছবিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তৈরি হলেও মুক্তির প্রাক্কালে ক্ষমতায় আসে হাসিনা সরকার। যথারীতি আটকে যায় সিনেমাটি।
এটিতে রয়েছে তরুণ সমাজের নতুন বাংলাদেশের গল্প। মজার তথ্য, যে গল্পটা বাস্তবে রচিত হয়েছে সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। ধারণা করা হচ্ছে, এই গল্পটিই ১৫ বছর আগে নির্মাণ করে বসে ছিলেন এনামুল করিম নির্ঝর। এখনও ‘নমুনা’ মুক্তি পাবে এমনটা মনে করেন না নির্মাতা নির্ঝর।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের টানা ১৬ বছরের শাসনামলে ছয়টি আলোচিত সিনেমা আটক বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল সেন্সরবোর্ড। সংখ্যার বিচারে হয়ত এটি খুব বেশি নয়, কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এটি একটি ভয়ংকর বার্তা দেয়। এই ৬টি ছবি না আটকালে ১৬ বছরে হয়তো এমন আরও ৬০টি ছবি নির্মাণ হতো। সংস্কৃতিবোদ্ধারা সরকারের এই আচরণকে ‘স্টপ দ্য ফ্রিডম অব স্পিচ’ বলে অভিহিত করেছেন।