।। শামীমা চৌধুরী শাম্মী ।।
বিএনএ, ঢাকা: এতক্ষণ যে ফিলিস্তিনি শিশুটি জরুরি সেবায় ফোন করে বাঁচার আকুতি জানিয়েছে, তার নাম হিন্দ রাজাব। বয়স মাত্র ছয় বছর। সে টেলিফোনে যা বলেছে তার বাংলা অর্থ ‘আমি খুব ভয় পাচ্ছি। দয়া করে তোমরা আসো।’
হিন্দ রাজাব ২৯ জানুয়ারি চাচা-চাচি আর তিন চাচাতো ভাইবোনের সঙ্গে গাজা সিটি থেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী তাল-আল-হাওয়া যাচ্ছিল। পথে তাদের বহনকারী গাড়ি ইসরায়েলের ট্যাংকের মুখে পড়ে। ইসরায়েলের সেনারা গুলি চালায়। এতে গাড়িতে মারা যায় সবাই।
হিন্দ ও জরুরি কল অপারেটরের মধ্যকার অডিও কথোপকথনের তথ্য অনুযায়ী, হিন্দ ওই সময় ইসরায়েলি বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে গাড়িতে থাকা স্বজনদের মরদেহের মধ্যে লুকিয়ে ছিল।
৬ বছর বয়সী শিশুটি গাড়িতে বসেই ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জরুরি নম্বরে ফোন দেয় এবং তাকে উদ্ধার করার আকুতি জানায়। ফোন লাইনটি যখন কেটে যায়, তখন সেখানে গুলির অনেক শব্দ হচ্ছিল। সম্ভবত: দ্বিতীয় দফা গুলিতে মরদেহের ভিতরে লুকিয়ে থাকা শিশু হিন্দ রাজাবও মারা যায়।
বিবিসি জানায়, শিশু হিন্দ রাজাবের সেই ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে উদ্ধার করতে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গিয়েছিল ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দুই প্যারামেডিক। কিন্তু এরপর থেকে তাদেরও হদিস পাওয়া যাচ্ছিলো না। সেই ঘটনার ১২ দিন পর ১০ ফেব্রুয়ারি ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে হিন্দ ও তার পাঁচ স্বজন এবং রেড ক্রিসেন্টের দুই ক্রু-র মরদেহ পাওয়া গেছে।
গত শনিবার ফিলিস্তিনি রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির প্যারামেডিকস সে এলাকায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এত দিন না পারার কারণ, সেই এলাকায় ব্যাপক যুদ্ধ চলছিলো। সেখানে ঢোকা যাচ্ছিলো না। তারা সেখানে যাওয়ার পর হিন্দ যে কালো রঙের কিয়া গাড়িতে ছিল, সেটি দেখতে পান। এটির উইন্ডস্ক্রিন ও ড্যাসবোর্ড টুকরা টুকরা হয়ে পড়ে ছিল। গাড়ির চারপাশে ছিল গুলির চিহ্ন।
একজন প্যারামেডিক গণমাধ্যমকে বলেন, গাড়ির ভেতর থাকা ছয়টি মরদেহের একটি হিন্দ। এই গাড়িটির কয়েক মিটার দূরে ছিল আরেকটি পুড়ে যাওয়া গাড়ি। এটি উল্টে পড়ে ছিল। রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, হিন্দকে আনতে যে অ্যাম্বুলেন্সটি পাঠানো হয়েছিল, এটি সেটি।
ফিলিস্তিনি রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি এক বিবৃতিতে জানায়, ইসরায়েলের বোমা হামলায় অ্যাম্বুলেন্সের দুই ক্রু ইউসুফ আল-জেইনো এবং আহমেদ আল-মাধউন নিহত হন। ২৯ জানুয়ারি অ্যাম্বুলেন্সটি সেখানে পৌঁছানোর পর ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে এতে হামলা চালায়।
ফিলিস্তিনি রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি আরও জানায়, অ্যাম্বুলেন্সটিকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। তারপরও তারা শিশুটিকে উদ্ধার করতে যাওয়া রেডক্রস ক্রুদের ইচ্ছে করে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের এই কাজটি করতে গিয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে গিয়েছিলো।
ফিলিস্তিনি রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির মুখপাত্র নিবাল ফারসাখ বিবিসিকে চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে বলেছিলেন, ‘আমরা সমন্বয় করতে পেরেছি, সবুজ সংকেত পেয়েছি। ক্রুরা সেখানে পৌঁছানোর পর জানিয়েছে, তারা হিন্দ যে গাড়িতে ছিলো, সেটি দেখতে পেয়েছে এমনকি তাকেও দেখতে পেয়েছে। সর্বশেষ যা শুনছিলাম তা ছিলো গুলির শব্দ।’
ফিলিস্তিনি রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি কল অপারেটরদের সঙ্গে হিন্দের কথোপকথনের রেকর্ড প্রকাশ করেছে। এখন হিন্দের সঙ্গে আসলে কী ঘটেছে, তা তদন্ত করার জোর দাবি উঠেছে।
মেয়ের মরদেহ পাওয়ার আগে হিন্দের মা বলেছিলেন, তিনি মেয়ের জন্য ‘প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মুহূর্ত’ অপেক্ষা করছিলেন। তিনি রেড ক্রিসেন্টকে ইসরায়েল সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সমন্বয়ের ঘটনার বিস্তারিত প্রকাশ করার আহ্বান জানান।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী, চিকিৎসাকর্মীদের অবশ্যই সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং কোনোভাবে সংঘাতের লক্ষ্যবস্তু বানানো যবে না। পাশাপাশি আহত ব্যক্তিদের যতটা সম্ভব কম সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিতে হবে। কিন্তু ইসরায়েল এসব আইন-নীতি তোয়াক্কা না করে হিংস্রতা চালিয়ে যাচ্ছে।
শুধু শিশু হিন্দ রাজাব নয়, প্রতিদিন শতশত শিশুর বুক ঝাঁঝড়া হচ্ছে যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর হিংস্র বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের ঝনঝনানিতে। গত ৪ মাসে পুরো ফিলিস্তিনকে এখন কবরস্থানে পরিণত করেছে ইসরায়েলী বাহিনী।
বিএনএনিউজ/ বিএম/ হাসনা