বিএনএ, চট্টগ্রাম: ২০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ইছা বাদশা ওরফে মহসিনকে দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। মঙ্গলবার (৯ মে) অর্থঋণ আদালত চট্টগ্রামের বিচারক মুজাহিদুর রহমান এই আদেশ দেন।
খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ব্যবসায়ীকে কানাডা থেকে দেশে নিয়ে আসার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, ‘মামলাটির ২৩টি ধার্য তারিখ অতিবাহিত হলেও আসামি আদালতে উপস্থিত হননি। বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ রায় দিয়েছেন।’
আদালত সূত্র জানায়, আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন, ইছা বাদশার বিরুদ্ধে এই আদালতে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলা রয়েছে। এসব মামলায় ঋণখেলাপির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এসব ব্যাংকের মামলায় ব্যবসায়ী ও তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য কখনো হাজির হননি। দেননি ওকালতনামাও। ব্যাংকের হলফনামাযুক্ত আবেদনে দেখা যায় ব্যবসায়ী ইছা বাদশা দেশত্যাগ করে বর্তমানে কানাডা বসবাস করছেন। বাংলাদেশ ত্যাগ করায় তাঁর বিরুদ্ধে ইস্যু করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষে তামিল করা সম্ভব হবে না। খেলাপি ঋণ আদায়ের বিশেষ উদ্দেশ্যে অর্থঋণ আদালত প্রতিষ্ঠা হয়। নাগরিকদের আমানতের অর্থ পাচারকারী এই শীর্ষ ঋণখেলাপিকে কানাডা থেকে ফিরিয়ে এনে জনগণের অর্থ আদায় সুনিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
আদেশে আরও বলা হয়, অর্থ পাচারকারী ঋণখেলাপিরা বিদেশে পলাতক থাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম সফল হচ্ছে না। এসব মামলার পেছনে আদালতের গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার কারণে মামলাজট বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থায় খেলাপি ঋণ আদায়ে বিচারিক কার্যক্রম সফল করার জন্য বিদেশে বসবাসকারী ঋণখেলাপিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
জানা যায়, ব্যাংকের টাকা মেরে কানাডায় বিলাস বহুল জীবন যাপন করছেন ইছা বাদশা। জাহাজ ভাঙাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে আটটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আর শোধ করেননি। এখন কানাডার টরন্টোর লেকশোর এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বাড়ি ও নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার।
মামলার বাদী ওয়ান ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার জুয়েল দাশ বলেন, ‘আদালত একাধিকবার সমনজারি করলেও ইছা বাদশা হাজির হননি।কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আদালতকে অবহিত করলে আসামি ইছাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে এ নির্দেশ দেন বিচারক।’
প্রসঙ্গত, বাদশা মিয়া সওদাগর চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে গড়েছিলেন বাদশা গ্রুপের নামের প্রতিষ্ঠান। তবে বাবা মারা যাওয়ার পর গ্রুপের তালা মার্কা সাবান ও ভেজিটেবল অয়েলের সুনাম আর ধরে রাখতে পারেনি তার দুই ছেলে মোহাম্মদ ইছা বাদশা ওরফে মহসিন ও মোহাম্মদ মুসা বাদশা।
চট্টগ্রামের বাকলিয়ার বাদশা মিয়া সওদাগর তালা মার্কা সাবান ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাদশা গ্রুপের যাত্রা শুরু করান। পরে তার ছেলেরা পুরনো জাহাজ এনে ভাঙার বা স্ক্র্যাপের ব্যবসা শুরু করেন। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ট্রেডিং অ্যান্ড কমিশন এজেন্ট মুসা ইছা ব্রাদার্স, স্ক্র্যাপ ট্রেড ও শিপ ব্রেকার্স প্রতিষ্ঠান মেসার্স ঝুমা এন্টারপ্রাইজ, ট্রেডিং অ্যান্ড কমিশন এজেন্ট এমএম এন্টারপ্রাইজ, সাবান ও তেল কোম্পানি বাদশা ওয়েল অ্যান্ড সোপ ফ্যাক্টরি ও ডেইরি অ্যান্ড ডেইরি ফুড প্রোডাক্ট প্রতিষ্ঠান আজান এন্টারপ্রাইজ (প্রস্তাবিত)। এছাড়া খাতুনগঞ্জের বাণিজ্যিক ভবন বাদশা মার্কেটসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েন তারা। সবকটি প্রতিষ্ঠানেরই প্রধান কার্যালয় বাদশা মার্কেট ১৭৩, খাতুনগঞ্জ, চট্টগ্রামে। বড়ভাই ইছা বাদশা মিডল্যান্ড ব্যাংকের স্পন্সর (উদ্যোক্তা) পরিচালক ছিলেন। বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি হওয়ায় পরিচালক পদ থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়। ওই ব্যাংকে ইসা-মুসার ৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
ইছা ও মুসার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় এমএম এন্টারপ্রাইজ ও ঝুমা এন্টারপ্রাইজের নামে পাওনা ১৫৬ কোটি ৩৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, ওয়ান ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখায় মুসা অ্যান্ড ইসা ব্রাদার্সের নামে পাওনা ১৬৮ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় ঝুমা এন্টারপ্রাইজের নামে পাওনা প্রায় ৫৬ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখায় মুসা অ্যান্ড ইসা ব্রাদার্সের নামে পাওনা ১৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা, মার্কেটাইল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখায় তাদের খেলাপি ঋণ প্রায় ৭৫ কোটি টাকা টাকা, মেঘনা ব্যাংক জুবিলী রোড শাখায় তাদের খেলাপি ঋণ প্রায় ৬০ কোটি, প্রাইম ব্যাংকে ঝুমা এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ বাবদ পাওনা ৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এছাড়া আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকেও ‘বড় অঙ্কের’ ঋণ আছে।
বিএনএ/এমএফ