বিএনএ, চট্টগ্রাম: সারা দেশে গতকাল শনিবার বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। এ অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ অভিযানের কথা জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনায় গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এদিকে ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছে চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ (২৫)। গত ৩০ জানুয়ারি তাকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। ফেসবুক লাইভে থানার ওসিকে পেটানোর হুমকির পর পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পুরস্কার ঘোষণার পর শুক্রবার ১১ দিন পার হয়েছে। এখনও সাজ্জাদের নাগাল পায়নি পুলিশ। এদিকে শুরু হওয়া অপারেশন ডেভিল হান্টে কি ধরা পড়বে সাজ্জাদ এমন প্রশ্ন নগরের সাধারণ মানুষের ।
সিএমপি সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের এক সময়ের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খানের অনুসারী ছোট সাজ্জাদ। সেই সাজ্জাদ ছিল দুই যুগের বেশি সময় আগে সংঘটিত এইট মার্ডার মামলার দণ্ডিত আসামি। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পলাতক। নগরীতে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল সাজ্জাদ আলী খান। একে-৪৭ রাইফেলসহ ২০০০ সালে একবার গ্রেফতার হয়েছিল। চার বছর কারাগারে থাকার পর ২০০৪ সালে জামিনে ছাড়া পায়। এরপর বিদেশে পালিয়ে গিয়ে আর ফেরেনি। সে চাঁদাবাজি করত নগরীর বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারী এলাকায়। সেখানে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে বালুর ব্যবসা ও জমি কেনাবেচা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে সে। সাজ্জাদ আলী খানের সাম্রাজ্যেই এখন বিচরণ ছোট সাজ্জাদের। চট্টগ্রাম নগরীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অঘোষিত ডন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ছোট সাজ্জাদ। গত ২৮ জানুয়ারি রাত ১০টা ৩৯ মিনিটে নিজের ফেসবুক লাইভে এসে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি আরিফ হোসেনকে পেটানোর হুমকি দেয় ছোট সাজ্জাদ। ওইদিন রাতে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ওসি। ডায়েরি করার দুদিনের মাথায় ৩০ জানুয়ারি সাজ্জাদকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করে সিএমপি। ১৯ মিনিট ২৯ সেকেন্ডের ওই ফেসবুক লাইভের ভিডিও এখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। ভিডিওতে দেখা যায়, সাজ্জাদ ওসিকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে। সিএমপি কমিশনারকে ওসির ব্যাপারে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। তার মৃত্যু হলেও ওসিকে পেটাবে বলে জানায় ফেসবুক লাইভে।
হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর গ্রামের সোনা মিয়া সওদাগর বাড়ির জামালের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন। স্থানীয়ভাবে তাকে বুড়ির নাতি হিসেবে ডাকা হয়। ছোট সাজ্জাদ কৈশোর পেরিয়েই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় নাম তুলেছে। অন্তত পাঁচ বছর ধরে অপরাধ জগতে বেপরোয়া বিচরণ করছে। গেল দুই বছরে বেশ কয়েকটি বড় খুনের ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল সে। এরপর তাকে নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাজ্জাদ বেপরোয়া হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপর একাধিক খুনের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তি সে। এসব ঘটনায় তার সহযোগীদের নামও এসেছে। গত জুলাই মাসে একবার গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে ছাড়া পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে পড়ে।
একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনায় জড়িত থাকলেও ধরা না পড়ায় আতঙ্ক বেড়েছে জনমনে। নগরীর সঙ্গে লাগোয়া নিজের পৈতৃক বাড়ি হাটহাজারী এলাকায়ও নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত। নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায়ও অপরাধমূলক কাজে যুক্ত সে। এরপর সিএমপির বড় থানা চান্দগাঁও এবং পাঁচলাইশ এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সাজ্জাদ। হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজির ঘটনায় ১০ মামলায় আছে তার নাম। অভিযোগ রয়েছে, বিদেশে বসেই সাজ্জাদ আলী খান নির্মাণাধীন ভবন, বাসাবাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি করায় ছোট সাজ্জাদকে দিয়ে। তবে পুলিশ বলছে, ছোট সাজ্জাদ কারও ইশারায় অপরাধমূলক কাজ করে তেমন জোরালো কোনো প্রমাণ নেই। নিজেই দলবল নিয়ে হত্যা ও চাঁদাবাজিসহ অপরাধমূলক নানা কর্মকাণ্ড সংগঠিত করে।
গেল ২৯ আগস্ট রাতে হাটহাজারী কুয়াইশ-অক্সিজেন সড়কে মো. আনিস (৩৮) ও মাসুদ কায়ছারকে (৩২) গুলি করে হত্যা করা হয়। ডাবল মার্ডারের এই ঘটনার পর দায়ের হওয়া মামলার প্রধান আসামি সাজ্জাদ হোসেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের গত বছরের আগস্টে নগরীতে সংঘটিত সবচেয়ে বড় অপরাধমূলক ঘটনা ছিল এটি। পরের মাসে ১৮ সেপ্টেম্বর ৫ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে বায়েজিদ বোস্তামী থানার কালারপুল এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে প্রকাশ্যে গুলি চালান সাজ্জাদ। গুলি চালানোর ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরের মাসে ২১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানার অদুরপাড়া এলাকায় মাইক্রোবাসে এসে দিবালোকে গুলি করে আফতাব উদ্দিন তাহসীন (২৬) নামে এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করে সাজ্জাদ। এরপর পুলিশ তাকে ধরতে জোর দিলেও ফলাফল শূন্য। গত ৫ ডিসেম্বর তাকে গ্রেফতারে বড় অভিযান চালায় পুলিশ। এই অভিযান থেকে অল্পের জন্য ফসকে যায় সাজ্জাদ। অভিযানের সময় পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হয়।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি আরিফুর রহমান বলেন, ছোট সাজ্জাদ একটা টোকাই সন্ত্রাসী। তাকে ধরতে থানা পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। পালিয়ে বেশি দিন থাকতে পারবে না। পুলিশের হাতে ধরা পড়বেই।
পুরস্কার ঘোষণার পর কোনো ধরনের তথ্য পেয়েছেন কি না এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা নানাভাবে সাজ্জাদের তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। যাতে তাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা যায়।
ফেসবুক লাইভে আপনাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তির সহায়তায় লাইভ চলাকালে তার লোকেশন চিহ্নিত হয়েছে এ প্রশ্নে তিনি বলেন, যেদিন লাইভে হুমকি দেয় সেদিন তার অবস্থান কোথায় ছিল তা আমরা যাচাই করেছি। তবে ঠিক কোন জায়গা থেকে লাইভ করেছে সেই এলাকা চিহ্নিত করা যায়নি।
এ বিষয়ে সিএমপির উপ-কমিশনার (উত্তর) মুহাম্মদ ফয়সাল আহম্মেদ বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদকে ধরতে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। সে ধরা পড়বেই। বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসিকে ফেসবুক লাইভে হুমকি দেওয়ার পর তাকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। আশা করছি তাকে খুব সহসা ধরা হবে।
বিএনএনিউজ/ নাবিদ/ এইচমুন্নী