বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) সাত ভাই চম্পা খ্যাত প্রথম নারী শিক্ষক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রথম ডিন দিল আফরোজ খানমের ঝালকাঠির অজপাড়াগাঁ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে উঠার গল্প, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা, সর্বোপরি তাঁর আজকের এই অবস্থানে আসার অনুপ্রেরণা ও প্রতিবন্ধকতার গল্প তুলে ধরছেন বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ) এর প্রতিনিধি মো. রবিউল ইসলাম
প্রতিনিধি: সাতভাই চম্পা এই নামের রহস্য কী?
দিল আফরোজ: বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে ২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে আমি এবং আরো সাতজন পুরুষ শিক্ষক জয়েন করে। সাতজন পুরুষ শিক্ষক আর আমি একা নারী শিক্ষক হওয়ায় আমাদেরকে সাত ভাই চম্পা বলে ডাকত সবাই, সেই থেকেই সাত ভাই চম্পা।
প্রতিনিধি: বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
দিল আফরোজ: আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষক হতে পেরে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করছি। শুরু থেকেই সকলের সহযোগিতা এবং স্নেহ পেয়েছি। তাই সফলতার সাথে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রতিনিধি: আপনার শিক্ষক হয়ে ওঠার পিছনের গল্পটা জানতে চাই।
দিল আফরোজ: আমি বেড়ে উঠেছি ঝালকাঠি জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। গ্রামের অন্য মেয়েদের মতো পড়াশোনা করেছি। শিক্ষক হয়ে ওঠার পিছনে ছোট একটা গল্প আছে। আমি যখন ঝালকাঠি হরচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ি তখন আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন মারুফা বেগম। মারুফা বেগম ম্যা’মের পড়ানোর স্টাইল, আচার আচরণ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। এক পর্যায়ে আমার মনে হতে থাকে আমিও ম্যামের মত শিক্ষক হবো। ক্রমে ক্রমে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ, কলেজ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময়ে নারী শিক্ষকদের দেখেও আমার আগ্রহ জন্মে শিক্ষক হওয়ার। এর পরে পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া।
প্রতিনিধি: একজন নারী শিক্ষার্থী হিসেবে আপনি কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হয়েছেন কিনা?
দিল আফরোজ: একজন নারী শিক্ষার্থী হিসেবে বা ছাত্রী হিসেবে আমি যখন এসএসসি, এসএসসি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিংয়ের জন্য ঢাকায় যায় তখন অনেকে অনেক কটু কথা বলেছে। একটা কথা এখনো আমার মনে পড়ে, একজন আমাকে বলেছিলেন যে ঢাকায় যাচ্ছো বিল্ডিং দেখে যেন আবার উল্টে পড়ো না। এমন নানা বিষয়, মেয়ে হয়ে পড়ার জন্য ঢাকা যাচ্ছি এটা নিয়ে তাদের কাছে একটা বিরূপ ধারনা জন্মে। একটা মেয়ের কেন এত পড়াশোনা করতে হবে ইত্যাদি।
প্রতিনিধি: সমাজের এই বাঁকা দৃষ্টিভঙ্গি ডিঙ্গিয়ে আপনি কীভাবে এপর্যন্ত আসলেন?
দিল আফরোজ: সমাজের এইসব ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আমার ভিতরে একটা জিদ তৈরি হয়। আমার স্বপ্ন পূরণ করে আমি তাদের দেখিয়ে দিতে চাই যে আমিও পারি। আমি ছুটেছি আমার লক্ষ্যের দিকে। জিদকে আমি অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে আজকের এই পর্যায়ে আমি।
প্রতিনিধি: নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সমাজের এই প্রচলিত ধারণা কাটিয়ে কীভাবে একজন নারী শিক্ষার্থী তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাবে?
দিল আফরোজ : আমি সবসময় আমার শিক্ষার্থীদের বলি সমাজ কি বললো না বললো এদিকে কান না দেওয়ার জন্য। সমাজের কেউ তোমার কাজকে বাঁকা ভাবে দেখলে তুমি সেটাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিবে। তুমি তোমার লক্ষ্য অর্জন করে একদিন সমাজকে দিয়ে দেখিয়ে দিবে যে তুমি ঠিক তাঁরা ভুল।
প্রতিনিধি: আমাদের সমাজে অনেক পরিবার আছেন যেখানে তাঁর স্বামী বা পিতা চায় না তাঁর মেয়ে বা স্ত্রী চাকরি করুক। এক পর্যায়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে নারীরাও সমাজে/পরিবারের চাপে চাকরি করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এই পর্যায় থেকে উত্তরণের পথ কী?
দিল আফরোজ : চাকরি করবে এমন মানসিকতার সবাই না। আবার সবাইকে চাকরি করতেই হবে এমনটাও না, চাকরি করবে কি করবে না এই স্বাধীনতাটাও নারীর থাকা উচিত। আমাদের সমাজে সবথেকে বড় যে জিনিসটা প্রয়োজন সেটি হলো নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি। নারীকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত করতে পারলে তার সামাজিক মুক্তিও মিলবে সহজে। একজন নারী যদি তাঁর পিতার উপর নির্ভরশীল হয় তাহলে তাঁর পিতার অর্থনৈতিক সংকটের সময় তাঁকে দেখভাল করার কেউ থাকেনা।দুর্ভাগ্যবসত তাঁর স্বামী যদি মারা যায় বা অসুস্থ হয়ে পড়ে তখনও তার খরচ যোগানোর জন্য কেউ থাকেনা। এইজন্য নারীকে স্বাবলম্বী হতে হবে, নারীকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত করতে হবে।
বিএনএ/এমএফ