বিএনএ, ইমরান খান: বাবার সংসারের ছোট মেয়ে ফাতেমা। বয়স মাত্র ১৫। বিয়ে হয় আরও বছর দুই আগে। ৬ মাস বয়সের পুত্র সন্তান ইয়াসিনকে নিয়ে ছিলেন স্বামীর সংসারে।
ফাতেমার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের শরিফগঞ্জ গ্রামে। বাবার নাম হায়েজুল ইসলাম। পরিবারের ছোট মেয়ে ফাতেমা অভাবের তাড়নায় পেরোতে পারেননি প্রাথমিকের গণ্ডি। জীবীকার তাগিদে ১৩ বছর বয়সেই পরিবার নিয়ে চলে আসেন ঢাকার ধামরাইয়ে। উপজেলার গাংগুটিয়া ইউনিয়নের চারিপাড়া হাতকোড়া গ্রামে থাকতেন ভাড়া বাসায়। সংসার চালাতে দুই থেকে আড়াই’শ টাকায় কাজ করতেন রাজমিস্ত্রীর সহযোগী হিসেবে।
পরিবারের সদস্যদের আয়-রোজগারে ভালই চলছিলো তাদের। কাজের ফাঁকে হঠ্যাৎ একদিন দেখা হয় একই (হাতকোড়া) গ্রামের বারেকের ছেলে তামিমের সাথে। প্রথম দেখাতেই একে অপরকে ভাললেগে যায় তাদের। এক পর্যায়ে তাদের মাঝে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক।
ফাতেমার চোখে এখন নতুন স্বপ্ন। ভালবাসার মানুষকে নিয়ে সুখের ভেলায় ভেসে গেছেন তিনি। সম্পর্কের কিছুদিন পর সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করবেন তারা। বয়স কম হওয়ায় সম্পর্ক মেনে নিতে চায়নি তাদের পরিবার। তবে ভালবাসা কি আর বাধা মানে। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে পালিয়ে বিয়ে করলেন তামিম-ফাতেমা।
বিয়ের পরও ভালই চলছিলো দুজনের। বছর ঘুরতেই সংসারে আসে নতুন অতিথি। ফাতিমার কোলজুড়ে ফুঁটফুটে পুত্র সন্তান। এবার ফাতিমার স্বপ্ন সন্তানকে ঘিরে। মানুষের মতো মানুষ করবেন ছেলেকে। নিজের জীবনের সব অপূর্ণতা পূরণ করবেন সন্তানের মধ্যে দিয়ে। তবে সেখানে বাধ সাধে ভয়াল মাদক। বিয়ের পর কিছুটা বুঝতে পারলেও দিন-মাস গড়াতেই তা পরিস্কার হয়ে ওঠে ফাতেমার কাছে। সংসার জীবনে শুরু হয় অশান্তি।
সংসারের টানাপোড়েন আর তামিমের মাদকাসক্তি দুই মিলে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকতো স্বামী স্ত্রীর মাঝে। পারিবারিক কলহ যেন নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় তাদের। সন্তানকে ঘিরে ফাতেমার স্বপ্ন যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে থাকে। অভাব-অনটন আর স্বামীর নির্যাতনে জীবনের প্রতি মায়াই উঠে যায় ফাতিমার। মাস কয়েক আগে বিষ খেয়ে একবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন তিনি। সেবার হয়তো সৃষ্টিকর্তা হয়তো ফাতেমার প্রতি রহমই করেন।
এরপর দিন যায় ফাতিমার সংসারের অশান্তিও বাড়তে থাকে। সোমাবার (৭ মার্চ) দুপুরে স্বামীর জন্য রান্না করছিলেন ফাতেমা। এসময় বিদ্যুতের বেগে বাড়িতে এসে ফাতেমাকে ঘরের ভেতর ডাকে তামিম। মাদক কিনতে টাকার জন্য ফাতেমাকে চাপ দেয় সে। ফাতেমা টাকা দিতে অস্বীকার করলে শুরু হয় তর্কবিতর্ক। একপর্যায়ে দা দিয়ে ফাতেমাকে কোপাতে থাকে তামিম। মুহুর্তেই ফাতেমার নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ঘরের মেঝ ভেসে যায় ফাতেমার রক্তে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ফাতেমার। ছেলে ইয়াছিনকে নিয়ে তার বুনা স্বপ্ন ঢেকে যায় কালো মেঘে।
স্থানীয়রা জানান, ঘাতক তামিম মাদক ব্যবসায়ী ও আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সদস্য। মাদক ব্যবসার সাথে সেবনও করতো সে। মাদক সেবনে টাকার টান পড়লেই স্ত্রীকে মারধর করে টাকা আদায় করতো তামিম। মাদক ও ছিনতাইয়ের একাধিক মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এলাকাবাসী জানান, তামিম মাদকাসক্ত হওয়ায় তাদের পরিবারে অনটন লেগেই থাকতো। নেশার টাকা যোগাড় করতে না পেরে টাকার জন্য স্ত্রীকেই নির্যাতন করতো সে। ফাতেমা টাকা দিতে অস্বীকার করায় নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে তামিম। ঘরের মধ্যে ফাতেমার মৃত্যু হলে দৌড় পালানোর চেষ্টা করে তামিম। এলাকার লোকজন তামিমকে আটক করে গাছের সাথে বেঁধে রাখে। পরে ধামরাই থানা পুলিশকে খবর দেয় স্থানীয়রা।
হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তামিমের চাচা মালেক জানান, তিনি নিজের ঘরে শুয়ে ছিলেন। দুপুরের দিকে তামিম আর ফাতেমার ঝগড়ার আওয়াজ শুনে এগিয়ে যান তিনি। ঘরের ভিতর গিয়ে দেখেন মাটিতে পড়ে আছে ফাতেমার নিথর দেহ। এসময় তামিম পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে ধরতে তিনি তার পেছনে পেছনে দৌড় দেন। পরে তামিমকে ধরে গাছের সাথে বেধে রাখা হয়।
নিহত ফাতেমার বড় বোন হাজেরা আক্তার বলেন, নেশাগ্রস্ত তামিমকে বিয়ে করে তার বোনকে জীবন দিতে হয়েছে। টাকার জন্য ফাতেমাকে বার বার নির্যাতন করতো সে। সবশেষ ফাতেমা আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তাকে বুঝিয়ে তামিমের কাছে পাঠায় স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহিনুর ইসলাম। ফাতেমার দায়িত্ব নিয়ে শাহিনুর বলেন, কিছু হলে সকল দায় তার। এখন এই হত্যার দায় কে নিবে সে প্রশ্ন তোলেন ফাতেমার বোন।
নিহত ফাতেমার পিতা হায়েজুল ইসলাম মেয়ের শোকে বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না সন্তানের মৃত্যু। বলেন, তামিমের সাথে ফাতেমাকে বিয়ে দেয়ার পক্ষেই ছিলেননা তিনি। ফাতেমাকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করে তামিম। আবেগের বশে করা সেই ভুলের খেসারত ফাতেমাকে জীবন দিতে দিতে হলো। এসময় সন্তান হত্যার দৃষ্টামূলক বিচার দাবি করেন হায়েজুল ইসলাম।
ধামরাই থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) নির্মল কুমার দাস বলেন, স্থানীয়দের মাধ্যমে ফাতেমা হত্যার খবর জানতে পারেন তারা। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আর ঘাতক তামিমকে কোর্টে চালান দেয় পুলিশ।
বিএনএ নিউজ/ সাভার প্রতিনিধি, এ আর