37 C
আবহাওয়া
৭:২৬ অপরাহ্ণ - এপ্রিল ১৯, ২০২৪
Bnanews24.com
Home » শহীদ এ.বি. এম আব্দুর রহিমের ৫১তম অন্তর্ধান দিবস আজ

শহীদ এ.বি. এম আব্দুর রহিমের ৫১তম অন্তর্ধান দিবস আজ

শহীদ এ.বি. এম আব্দুর রহিম

আজ ৫ই মে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে শহীদ এ.বি. এম আব্দুর রহিম ওরফে ইউসুফ মোল্লা’র অন্তর্ধান দিবস । পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁর কর্মস্থল পোস্তগোলাস্থ উজালা ম্যাচ ফেক্টরী থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে তেজগাঁও থানায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়। এ বি এম আবদুর রহিম। ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাসুদেব ইউনিয়নের অন্তর্গত ঘাটিয়ারা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মোল্লা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা খুরশিদ মোল্লা ও মা মোসম্মৎ ফাতেমা খাতুনের দুই ছেলে ও তিন কন্যার মধ্যে দ্বিতীয় পুত্র এ বি এম আবদুর রহিম যিনি  ইউসুফ নামেই এলাকায় পরিচিত ছিলেন।

তিনি শৈশব থেকেই ডানপিটে ও সাহসি ছিলেন। মানুষের সাথে দ্রুত মিশে যাওয়ার অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল তাঁর। ছাত্র জীবনে দুর্বার রাজনীতি ও দেশপ্রেম তাকে সংগ্রামী জনতার কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। খেঁটে খাওয়া মানুষের প্রতি তার দরদ একটু বেশীই ছিল। শ্রমিকের অধিকার আদায়ের নিরন্তর যুদ্ধ তার ভেতরও সংক্রমিত হয়েছে। তাই তিনি আমৃত্যু শ্রমজীবী মানুষদের সুখদুঃখের সাথী হয়েই কাটিয়েছেন।

স্কুলে পড়ার সময় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ ওঠেছিল কিশোরগঞ্জেও। মায়ের ভাষার দাবীতে ছাত্ররা নেমে পরে রাজপথে। সেখান থেকে স্কুল ছাত্র আবদুর রহিম গ্রেপ্তার হন। চাচা পুলিশ কর্মকর্তা ও স্কুলের ছাত্র বিবেচনায় তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। শ্রম আইনে তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তাই তিনি শ্রমিক রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পরেন। ১৯৬৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপাইন হতে ট্রেড ইউনিয়নের ওপর ১০ সপ্তাহের বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করেন। পশ্চিম জার্মানিতে তিনি লেবার রিলেশনের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি চীন ও রাশিয়ার ট্রেড ইউনিয়নের সফরকারী শ্রমিক প্রতিনিধি দলের প্রটোকল দেয়ার জন্য তাঁর ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে ন্যস্ত প্রটোকল অফিসারের দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করেন। এছাড়া একই সময়ে তিনি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের শ্রমিক প্রতিনিধি হয়ে রাষ্ট্রীয় ভাবে আইএলও সম্মেলনে যোগ দেন। তিনি জীবদ্দশায় শ্রমিক অধিকার আদায়ের  বিশ্বব্যাপী জাগরণ তৈরির আন্দোলনের অংশহিসেবে ৩৬টি দেশ সফর করেন। তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের দেশের শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং কল্যাণের জন্য কাজ করেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর জাগ্রত বিবেক ও শাণিত চেতনা স্বাভাবিক ভাবে তাকে মুক্তির সংগ্রাম তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের সোনালি অধ্যায় উন্মোচনের মিছিলে সংযুক্ত করেছে।

শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিক আন্দোলন এবং মুক্তির সংগ্রামের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলন বেগবান করার কাজে আত্মনিয়োগ করায় ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ বি এম আবদুর রহিম ও তার পরিবারের সকল সদস্যদের ঢাকায় পোস্তগোলাস্থ তাঁর কার্য্যালয় উজালা ম্যাচ ফেক্টরিতে প্রায় পনের দিন নজর বন্দি করে রাখে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হস্তক্ষেপে ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম সেখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে যান।

মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি তার ঢাকাস্থ ডিআইটি রোডের নিজ বাসার আম গাছের মগডালে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ান। সংগঠিত করতে থাকেন শ্রমিকদের। লক্ষ্য একটাই দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে জানবাজি রেখে যুদ্ধ করা। ২৫ মার্চের কালো রাতে অতর্কিত রাজারবাগ পুলিশ লাইনে শুরু হয় বৃষ্টির মতো গুলি। পাল্টা গুলিও চলে। রেহায় পায়নি সেই আমগাছ, সেই পতাকা। পাক সেনাদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় সব। ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে দেশময় পাকিস্তানি শাসকচক্র ও সেনাবাহিনীর হাতে নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। আবদুর রহিম তাঁর ছোট ছোট পাঁচটি শিশু ও স্ত্রীকে ফেলে এক কাপড়ে বেরিয়ে যান। সে সময় অকুতোভয় ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক মুখোমুখি হয় পাকবাহিনীদের। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গোপন সভার মাধ্যমে শ্রমিকদের উজ্জীবিত করার কাজও শুরু করেন তিনি।

সর্বশেষ সভা করেছিলেন ৫ মে ১৯৭১। পোস্তগোলা উজালা ম্যাচ ফেক্টরীর ভেতরে চলছিল গোপন সভা। মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিকদের আরও বেশি অংশগ্রহণ কী ভাবে নিশ্চত করা যায়, সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য শ্রমিকদের কী ভাবে ভারত পাঠানো যায়, এ-সব বিষয়গুলোই ছিল আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর কাছে বিষয়টি গোপন থাকেনি। পাকিস্তানি দালালেরা ঠিক ঠিক সংবাদটি পৌঁছে দেয় ওদের কাছে। ঢাকা সেনানিবাস থেকে একদল সৈনিক এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এরপর কারাগারে আটক রেখে এ বি এম আবদুর রহিমের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। তেজগাঁও থানায় তাঁর বিরুদ্ধে রুজু করা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পর্যন্ত তাকে দেয়া হতো না। তাঁর মা মোসাম্মৎ ফাতেমা বেগম ও স্ত্রী মিসেস ঝর্ণা রহীম দেখা করার অনুমতি চেয়েও ব্যর্থ হন। প্রতি উত্তরে মে থেকে আগষ্ট পর্যন্ত বেশ কয়েক বার পাকসেনা লে: কর্ণেল হামিদ খান চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে ছিলেন যে এ বি এম আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ রয়েছে। তদন্ত চলছে। নির্দোষ প্রমানিত হলে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হবে। সর্বশেষ চিঠিতে জানানো হয়, তাঁকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর থেকে আর তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, দেশ স্বাধীন হয়। পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। বিজয়ের বেশে অনেকে দেশে ফিরে আসলেও ফিরে আসেননি এ বি এম আবদুর রহিম। পাকিস্তানিরা এভাবে ফিরতে দেয়নি অনেককেই। পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের নির্মমতার শিকার হয়ে দেশমাতৃকার জন্য শহিদ হয়েছেন এ বি এম আবদুর রহিম। আজও অপেক্ষা জানালায় দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর বিধবা স্ত্রী মিসেস ঝর্ণা রহীম ( কারু শিল্পী), চার ছেলে এবিএম সোহেল রশিদ ( কথাসাহিত্যিক, কবি ও অভিনেতা) মো. শাকিল রশিদ ( ইটালি প্রবাসী) মো. শ্যামুয়েল রশিদ ( ইটালি প্রবাসী) মো. সারজিল রশিদ ( প্রবাসী) ও একমাত্র কন্যা সায়কা জাবীন রশীদ ( কানাডা প্রবাসী)।

Loading


শিরোনাম বিএনএ