বিএনএ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা থানার অফিসার ইনচার্জ (পুলিশ পরিদর্শক (নি:) বিপি-৭৪০২০৬০৪২৩) সোহেল আহমেদকে থানা থেকে প্রত্যাহার এবং তার বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইজিপি’স কমপ্লেইন সেলে আবেদন জানিয়েছে মোহাম্মদ ইদ্রিচ (৬৫)। তিনি একজন কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আনোয়ারা উপজেলার ঝিওরী গ্রামের মৃত ছিদ্দিক আহমেদ পুত্র। আশির দশকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের অফিস সহকারী বর্তমানে পেশায় একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান।
শনিবার (৪ এপ্রিল) পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স-এ আইজিপি’স কমপ্লেইন সেল, অতিরিক্ত ডিআইজি (ডিএন্ডপিএস-১) বরাবরে পাঠানো ৫ পৃষ্ঠার ওই অভিযোগ পত্রের অনুলিপি দেয়া হয় ডিআইজি চট্টগ্রাম, পুলিশ সুপার চট্টগ্রাম ও সহকারি পুলিশ সুপার আনোয়ারা সার্কেল বরাবরে।
৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ মোহাম্মদ ইদ্রিচ আইজিপি’স কমপ্লেইন সেলে পাঠানো অভিযোগ পত্রে বলেছেন, মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক সদস্যের অপেশাদার আচরণ ও কর্মকান্ডের জন্য পুলিশের হাজার হাজার গৌরবময় ভালো কাজের সাফল্য ম্লান হতে বসেছে। এই অপেশাদার ও দুর্নীতিবাজ সদস্যের অন্যতম হচ্ছে, চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার বর্তমান অফিসার ইনচার্জ (পুলিশ পরিদর্শক (নি:) বিপি-৭৪০২০৬০৪২৩) সোহেল আহমেদ।
ইদ্রিচ বলেন, গত ৮ এপ্রিল বিকাল পৌনে ৫টার দিকে তার বাড়ির পাশে দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া থামাতে যান। এ সময় হাসান শরীফ (৪০), আবু সৈয়দ (৫০), জামির হোসেন (২৫), আশরাফ উদ্দিন, আব্দুর নুর (৩৫) আমাকে প্রথমে গালিগালাজ ও বেদম মারধর করে জখম করেন। এক পর্যায়ে ইট দিয়ে মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে।
তার আর্তচিৎকারে পুত্র আশরাফুল ইসলাম মুন্না (২৪) এগিয়ে এলে তাকেও মারধর করে চোখে জখম করে। পরে অন্য প্রতিবেশীরা এসে আমাদের পিতা-পুত্রকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করে আনোয়ারা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করান। পরে
আনোয়ারা থানায় যান এবং ওসি সোহেল আহমেদের সঙ্গে দেখা করেন। রক্তাক্ত অবস্থায় আমাকে দেখে ওসি সমবেদনা জানান এবং ঠান্ডা পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করেন। তাৎক্ষনিকভাবে একজন এসআইকে ডেকে একটি অভিযোগ নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আসামিদের গ্রেপ্তারের নিদের্শ দেন এবং আমাকে বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে পরে এসে মামলার কপি নিয়ে যেতে বলেন। এতে খুশি হয়ে আমরা পিতা-পুত্র বাড়িতে চলে আসেন।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে থানার দালাল স্থানীয় জামায়াত ইসলামী নেতা সাদ্দাম হোসেন (৩৫) ও বিএনপি নেতা মোহাম্মদ মুরাদ (২৫), অভিযুক্তরা থানায় যায়। এই দুই দালালের মাধ্যমে ওসি সোহেল আহমেদকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে সমর্থ হন তার মামলার আসামীরা। তারা থানা থেকে ফিরে রাত সাড়ে ১০ টার দিকে আমার বাড়িতে ফের চড়াও হয় এবং ইট পাথর নিক্ষেপ করে। অবস্থা বেগতিক দেখে পিছনে খালপাড় দিয়ে পালিয়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে থানায় উপস্থিত হন এবং ওসি সোহেল আহমেদকে তার মামলাটি রের্কড করে আসামীদের গ্রেপ্তারের জন্য অনুনয়-বিনয় করেন। কিন্তু ওসি সোহেল আহমেদ এই সময় রুদ্র মুর্তি ধারণ করে আমাকে অশালীন ভাষায় গালমন্দ করতে থাকেন।
গালমন্দের এক পর্যায়ে আমাকে প্রশ্ন করেন, “শালা বুড়া এতরাতে কেন থানায় এসে বিরক্ত করছিস?’’ জবাবে, ভোক্তভোগী বৃদ্ধ মোহাম্মদ ইদ্রিচ পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জানালে ওসি সোহেল “কিছুদিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আত্মগোপনে থাক’’ বলে তার কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন।
নিরুপায় হয়ে মাথায় গুরুতর জখম এবং বেদম মারধরের ফুলা আঘাতে অসুস্থ অবস্থায় আনুমানিক রাত ১টার দিকে চট্টগ্রাম শহরে এসে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। পরদিন ৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আসামীদের বিরুদ্ধে সিআর মামলা নং ২০৬/২০২৪ দায়ের করেন। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-৬ এর সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল হারুন মামলাটি আমলে নেন এবং আনোয়ারা থানার ওসিকে মামলাটি রের্কড করার নির্দেশ দেন।
এদিকে ৮ এপ্রিল বিকালের ঘটনায় ৯ এপ্রিল সকালে হামলা ও লুটপাটের অভিযোগ করতে অন্ধ মেন্না মিয়ার দুই কন্যা তসলিমা আক্তার (২৫) ও ইসমো আক্তার (২৩) আনোয়ারা থানায় মামলা করতে যায়। কিন্তু ওসি মামলা নেয়নি। পরে ১০ এপ্রিল তসলিমা আক্তার বাদী হয়ে ৬জনকে আসামী করে চট্টগ্রাম চীফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ( সিআর মামলা-২০৭/২০২৪) মামলা করেন। আদালত মামলাটি তদন্ত করার জন্য আনোয়ারা থানার ওসিকে নির্দেশ দেন।
দুই মামলার আদালতের আদেশের কপি হাতে পেয়ে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন ওসি সোহেল আহমেদ। তিনি এই সময় পুলিশের এক এসআইকে ডেকে চিৎকার করে বলেন, ‘শালা আদালতে গেল কেন? বুড়ারে ধরে নিয়ে আয়’। কিন্তু আমি বাড়িতে না থাকায় তাকে থানায় ধরে নিতে পারেনি পুলিশ।
কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইদ্রিচ অভিযোগ করেন, ওসি সোহেল আহমেদ প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে তার দায়ের করা মামলার আসামিদের থানায় ডেকে নিয়ে ঘটনার ৯ দিন পর মনোয়ারা বেগম (৪৫) নামে এক মহিলা বাদী করে একটি মামলা নেন ১৮ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টায় পাল্টা মামলা নেন। যা থানার নম্বর ১৭ (৪) ২০২৪। ধারা ১৪৩/৩২৩/৩২৬/৩০৭/৩৫৪/৩৭৯/৫০৬ (২১) পেনাল কোর্ড ১৮৬০)।
সাজানো, মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা থেকে ২৩ এপ্রিল মোহাম্মদ ইদ্রিচসহ মামলার সব আসামী চট্টগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন।। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম জেলা আদালতের পিপি, সিনিয়র অ্যাডভোকেট ইফতেখার সাইমুম চৌধুরী, সিনিয়র অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, অ্যাডভোকেট সাইফুদ্দীন মাহমুদ, অ্যাডভোকেট উম্মে সালমা চৌধুরীসহ একদল আইনজীবী বিজ্ঞ আদালতে আনোয়ারা থানার ওসি সোহেল আহমেদের অনিয়ম দুর্নীতি, তার অপেশাদার আচরণ এবং আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে ঘটনার ৯দিন পর পাল্টা মামলাটি গ্রহণ করার দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করেন।
সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল হারুন উপস্থাপনকৃত দলিলাদি ও যুক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে জামিন মঞ্জুর করেন।
আইজিপি’স কমপ্লেইন সেলে আবেদনে বৃদ্ধ মোহাম্মদ ইদ্রিচ অভিযোগ করেন আদালত থেকে জামিন নিয়েও শঙ্কামুক্ত হতে পারছেন না। কেননা প্রতিপক্ষ বলে বেড়াচ্ছে এবার ওসি সোহেল আহমেদকে দিয়ে তার তিনপুত্র আশরাফুল ইসলাম (মুন্না), সাইফুল ইসলাম (এমরান) ও আসিফুল ইসলাম (আকিব) এবং সাক্ষীদের ‘ইয়াবা’ মামলা দিয়ে সারা জীবনের জন্য কারাগারে আটকে রাখবে।
মোহাম্মদ ইদ্রিচ আনোয়ারা থানার ওসি সোহেল আহমেদ আমাকে এবং আমার দুইপুত্রকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে তা স্বপক্ষে কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করে।
বৃদ্ধ মোহাম্মদ ইদ্রিচ আনোয়ারা থানার ওসি সোহেল আহমেদের কারসাজি বিষয়ে বলেন, ঘটনার ৯ দিন পর দায়ের করা মামলায় বাদী মনোয়ারা বেগম উল্লেখ করেছেন- তার পরনের শাড়ি খুলে ছিড়ে তাকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। অথচ থানায় দায়ের করা মামলায় যে ছবি যুক্ত করা হয়েছে তাতে মনোয়ারার পরনে রয়েছে মেক্সি। সেই মেক্সিটি বিভিন্ন স্থানে কাচি দিয়ে কাটা হয়েছে। টেনে ছেঁড়া হয়েছে তেমন চিহ্ন নেই। তাছাড়া গলার অংশে মেক্সটি অক্ষত। শুধু মাত্র জামিন অযোগ্য যৌন নিগ্রহের ফৌজদারী দন্ডবিধি ৩৫৪ ধারা যুক্ত করার জন্য এমন মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। প্রমাণ হিসাবে মেক্সি পরিহিত বাদী মনোয়ারা বেগমের ছবিটি অভিযোগপত্রে যুক্ত করেছেন মোহাম্মদ ইদ্রিচ।
অভিযোগ পত্রে তিনি আর বলেন, মামলার বাদী মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে তার জমি বা বসতভিটা নিয়ে কোন বিরোধ নেই। দুইভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া থামাতেই তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। এতেই তাকে মারধর ও মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে এক ভাইয়ের সন্তান ও স্বজনরা। পিতা-পুত্র এক সঙ্গে প্রকাশ্যে কোন নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে কীনা এমন প্রশ্নও করেন মিথ্যা মামলার শিকার মোহাম্মদ ইদ্রিচ।
আনোয়ার থানার ওসি সোহেল আহমেদের বিরুদ্ধে করা এই অভিযোগে মোহাম্মদ ইদ্রিচ আরও উল্লেখ করেন। মিথ্যা ও সাজানো মামলার স্বাক্ষী মো. জমির (২৩) ও হাসান শরীফ (৪৮) আনোয়ারা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু তাদের চিকিৎসাপত্রে চিকিৎসক নাপা এক্সটেন্ড, ম্যাক্সপ্রো, রোলাক জাতীয় ঔষধ সেবনের পরার্মশ দিয়েছেন। যা নীলা ফুলা জখমের ৩২৩ ধারার আওতাধীন। কিন্তু থানার দালাল সাদ্দাম ও মুরাদের মাধ্যমে বাদী থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে থানায় দায়ের করা মামলায় কিরিচ দিয়ে কোপানো হয়েছে উল্লেখ করে ওসি সোহেল আহমেদ ৩২৬ ধারা যুক্ত করেছেন। যাতে চট্টগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন না পান। কেননা সাধারণত এই ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন হয় না, দায়রা আদালত বা হাইকোর্ট থেকে জামিন নিতে হয়। যা ওসি সোহেল আহমেদ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অপেশাদার আচরণ, ক্ষোভ ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে ধারাটি মামলায় যুক্ত করেছেন বলে অভিযোগ করেন মোহাম্মদ ইদ্রিচ।
বাংলাদেশ পুলিশের সুনাম, গৌরবোজ্জ্বল অর্জন সমূহ রক্ষা, দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন এবং ন্যায় বিচারের স্বার্থে আনোয়ারা থানার অফিসার ইনচার্জ (পুলিশ পরিদর্শক (নি:) বিপি-৭৪০২০৬০৪২৩) সোহেল আহমেদকে প্রত্যাহারের পাশাপাশি তার বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তপূর্বক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয় আইজিপি’স কমপ্লেইন সেলে করা মোহাম্মদ ইদ্রিচের ওই আবেদনে।
বিএনএনিউজ২৪ডটকম