।। সৈয়দ সাকিব ।।
বিএনএ, ঢাকা: রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের সম্পদের পাহাড় নিয়ে গত ৩১ মার্চ দৈনিক কালের কন্ঠ ‘বেএeনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশের পর সারাদেশে হৈ-চৈ পড়ে যায়। দেশ-বিদেশে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর জের না কাটতেই পত্রিকাটি ২ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে অপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজীপুর সদর উপজেলার ভাওয়াল গড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে ১৬০ বিঘা জমির ওপর বিস্তৃত ভাওয়াল রিসোর্ট। ২০১৮ সালের ৬ এপ্রিল প্রায় ১০৬ বিঘা জমির ওপর এটির যাত্রা শুরু। পরে এতে যোগ হয় আরো ৫৪ বিঘা জমি। ৬২টি ভিলার সঙ্গে হেলিপ্যাড, রেস্তোরাঁ, জিমনেসিয়াম, সুইমিংপুল, স্পাসহ অনেক কিছু রয়েছে এর ভেতরে। এই রিসোর্টের একটি বড় অংশই গড়ে তোলা হয়েছে বনের জমি জবরদখল করে। এতে নেপথ্যে থেকে সাহস জুগিয়েছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ। কেননা এই রিসোর্টের এক-চতুর্থাংশ শেয়ারের মালিকানা বেনজীরের পরিবারের হাতে।
বনের জমি দখল করে রিসোর্ট গড়ে ওঠার সময়কালে বেনজীর আহমেদ ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার। রীতিমতো পুলিশি পাহারা বসিয়ে বনের জমিতে সীমানাপ্রাচীর লাগিয়ে রিসোর্টের কাজ শুরু হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দারা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুলিশকর্তা বেনজীরের বনের জমি দখল করে রিসোর্ট বানানোর ঘটনায় স্তম্ভিত বন বিভাগ ও স্থানীয় বাসিন্দারাও।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আম্বার গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান এই ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা। প্রতিষ্ঠার কোনো একপর্যায়ে এতে যুক্ত হন বেনজীর আহমেদ। ডিএমপি কমিশনার হিসেবে প্রভাবশালী হওয়ার সুবাদে রিসোর্টের ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নেন তিনি।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, বেনজীরের ক্ষমতার দাপটে সবাই ছিলেন নির্বিকার, নিরুপায়। বেনজীর ডিএমপি কমিশনার থাকার কারণে বেআইনিভাবে পুলিশ পাহারায় বনের জমিতে সীমানা প্রাচীর দেন। নিরুপায় হয়ে বনের ওই জমি উদ্ধারে উচ্ছেদ মামলা করে বন বিভাগ। মামলাটি এখনো চলমান।
ভাওয়াল রিসোর্টের নির্মাণকাজ চলাকালে প্রায়ই এখানে আসতেন বেনজীর আহমেদ। কাজ চলার সময় স্থানীয় ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা দিনরাত পালা করে সেখানে পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকতেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যথারীতি এখানেও বেনজীর আহমেদ চাতুরীর মাধ্যমে নিজের নামটি ব্যবহার করেননি। স্ত্রী জীশান মীর্জা, দুই মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামেই রিসোর্টের শেয়ার কেনা হয়। জানা গেছে, এই রিসোর্টে এক রাত থাকতে গেলে গুনতে হয় সর্বনিম্ন ১১ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৭৬০ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ এলাকায় প্রতি বিঘা জমির বর্তমান মূল্য ২০ লাখ টাকা।
শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাবেক আইজিপির আরো সম্পদ রয়েছে। রাজধানীর বনানীতে অভিজাত হোটেল ইউনিক রিজেন্সিতে বেনজীর আহমেদের বিনিয়োগ রয়েছে। একইভাবে কক্সবাজারেও দুটি হোটেলে বিপুল অঙ্কের অর্থ লগ্নি করেছেন তিনি। পদ্মা ব্যাংক এবং কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাও কিনেছেন বেনজীর।
কালের কন্ঠ দাবি করেছে, বেনজীর আহমেদের দুবাইয়ে রয়েছে শতকোটি টাকার হোটেল ব্যবসা। সিঙ্গাপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগের সোনার ব্যবসা। এ ছাড়া থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় জমি কিনেছেন সাবেক এই আইজিপি।
তবে বেনজীর বিনিয়োগ করলেও তিনি কোথাও নিজের নাম রাখেননি। সব জায়গায় তিনি স্ত্রী জীশান মীর্জা, স্ত্রীর ভাই মীর্জা মনোয়ার রেজা, দুই মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে বিনিয়োগ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুবাই শহরের কেন্দ্রস্থল মাকতুম স্ট্রিটে অবস্থিত বিলাসবহুল কনকর্ড হোটেল অ্যান্ড স্যুইটসে মোটা অঙ্কের শেয়ার রয়েছে বেনজীরের। হোটেলটি বিখ্যাত দুবাই ক্রিকের ওপর দুর্দান্ত প্যানোরমিক ভিউ অফার করে। দুবাইয়ে অবস্থিত গ্র্যান্ড মসজিদ থেকে তিন মাইল দূরে এ হোটেলের অবস্থান।
দেশ থেকে টাকা পাচার করে গড়ে তোলা বেনজীরের এই হোটেলে আছে অ্যাপার্টমেন্ট, এক্সিকিউটিভ, স্যুইটসসহ অত্যাধুনিক রুম, যেগুলোর ভাড়া প্রতিদিন ৩৫০ থেকে দেড় হাজার দিরহাম, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা।
সিঙ্গাপুরের জনপ্রিয় মুস্তাফা মার্টের পাশে অবস্থিত নিজি জুয়েলার্সটির মালিকানায়ও রয়েছেন বেনজীর আহমেদ। দেশ থেকে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা পাচার করে সেখানে তিনি বিনিয়োগ করেছেন। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ বিদেশে বিনিয়োগের কোনো অনুমতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেননি। তাঁর কোনো প্রতিষ্ঠানের বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদনও দেওয়া হয়নি।
এ ছাড়া সোনালী ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে বেনজীর আহমেদ পাচার করেছেন বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বেনজীরের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে ঋণ দেওয়ার কথা স্বীকার করলেও কত টাকা দিয়েছে সেটি জানাননি বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বেনজীরের মালিকানা প্রকাশ্যে না আনলেও কক্সবাজারের কলাতলীতে দুটি বিলাসবহুল হোটেলে রয়েছে তাঁর বিনিয়োগ। হোটেল দুটির নাম হোটেল বেস্ট ওয়েস্টার্ন প্রিমিয়ার ও হোটেল রামাদা লিমিটেড।
বনানীর সি ব্লকের ১৫ নম্বর রোডের ৫৯ নম্বর বাড়ির ঠিকানায় আছে হোটেল ইউনিক রিজেন্সি। এ হোটেলেও বিনিয়োগ আছে বেনজীরের। হোটেলটিতে এক রাত থাকতে গেলে গুনতে হয় সর্বনিম্ন ১০০ ডলার বা ১২ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫০ ডলার বা ৩০ হাজার টাকা।
এ ছাড়া কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়েও বিনিয়োগ আছে বেনজীরের। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটি ক্যাম্পাস র্যাংগস আরএল স্কয়ার, প্রগতি সরণিতে অবস্থিত। আর স্থায়ী ক্যাম্পাস হচ্ছে পূর্বাচল নিউ টাউনের ৯ নম্বর সেক্টরে।
২০১৩ সালের ৩ জুন দি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড নামে যাত্রা শুরু হয় বর্তমানের পদ্মা ব্যাংক পিএলসির। ব্যাংকটির মালিকানায় আছেন বেনজীর পরিবারের সদস্যরা। ঋণ অনিয়মে ডুবতে বসা ব্যাংকটি ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক হিসেবে পুনরায় যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ব্যাবসায়িক দুরবস্থায় ২০২৪ সালের ১৭ মার্চ এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার চুক্তি করে।
চারদিকে নানা আলোচনা-সমালোচনার মাঝে মুখ খুলেছেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এবং র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। সবাইকে সামান্য ধৈর্য্য ধরতে অনুরোধ করেছেন তিনি।
এদিকে ২ এপ্রিল মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফাইড একাউন্ট সাংবাদিকদের প্রতি খোঁচা দিয়ে তিনি লিখেছেনঃ “দু একজন অনেক ক্ষিপ্ত, খুবই উত্তেজিত হয়ে এক্ষুনি সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, প্রবন্ধ লিখে ফেলছেন। দয়া করে সামান্য ধৈর্য্য ধরুন। ঘোষণাই তো আছে, কুৎসার কিসসা আভি ভি বাকি হ্যায়।”
বিএনএনিউজ/ বিএম/এইচমুন্নী