বিএনএ,ঢাকা: দাবা আর রাজনীতি অদ্ভুত এক খেলা! দুইটা খেলায় খুব ঠান্ডা মাথায় খেলতে হয়। দাবায় এক চালেই বাজিমাত হয়ে যেতে পারে, আবার এক ভুল চালেই পুরো খেলার খেলা শেষ! বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এখন একটি দাবা খেলার বোর্ড। ৫ই আগষ্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা একটি চাল দিতে ৩ দিন সময় পেয়েছিল। ৭২ ঘন্টার বেশি সময় পেয়েও ভুল চাল দিয়েছে! এখন সেই ভুল চালে আপসোস করছে।

অর্থ্যাৎ ৮ই আগষ্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্যারিস থেকে উড়ে এসে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহবুদ্দিনের কাছে শপথ না নিয়ে শহীদ মিনার, জাতীয় সৃত্মিসৌধে কিংবা সংসদ ভবনের সামনে গিয়ে শপথ গ্রহণ এবং প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক ঘোষণা করা সুযোগ ছিল। সেই প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক বা ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ এর ভিত্তিতে দেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের মতের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করা যেত। প্রায় সাড়ে ৬ মাস পরে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের তরুণ নেতাদের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির নতুন করে দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করা ঘোষণা দাবা খেলার ভুল চালের মতোই।
প্রসঙ্গত, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২২ অক্টোবর ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণা প্রথম আলোচনায় এনেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। সেদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা ও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে ‘বিপ্লবী ছাত্র–জনতার গণজমায়েত’ থেকে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়েছিল। সেটিরই একটি ছিল ‘জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটের আলোকে ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন করে প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক ঘোষণা এবং এর ভিত্তিতে দেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের মতের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করা’।
এরপর ওই পাঁচ দফা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিরা। শেষ পর্যন্ত দলগুলোর কাছ থেকে এসব দাবির ব্যাপারে সরাসরি ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে ‘সেকেন্ড রিপাবলিকের’ ধারণাটি পরে আর সেভাবে সামনে আসেনি। যদিও জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে কথা বলেছেন। এ ছাড়া বর্তমান সংবিধান বাতিলের দাবিও কয়েক মাস ধরেই করে আসছেন তাঁরা।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটিও তাদের সঙ্গে ছিল। ঘোষণাপত্র প্রকাশ সামনে রেখে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার বাংলামোটরে নিজেদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের’ মাধ্যমে বাহাত্তরের মুজিববাদী সংবিধানের ‘কবর’ রচিত হবে।
ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা নিয়ে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির মুখে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশে সরকারকে গত ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
তবে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সরকার কোনো ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেনি। ১৬ জানুয়ারি ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল ও অন্য অংশীজনদের সঙ্গে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু সেখানেও ঐক্যমত হয়নি।
গত শুক্রবার জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করেই বললেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।’
এদিকে ছাত্র-তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ এবং ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ কেন, তা জানতে চেয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, সেকেন্ড রিপাবলিক কখন হয়, গণপরিষদ কেন হবে?
শনিবার রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সংগ্রামে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের ত্যাগ ও নেতৃত্ব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সালাহ উদ্দিন আহমদ এ প্রশ্ন তোলেন।
ন্যাশনালিস্ট রিসার্চ ফাউন্ডেশন আয়োজিত সভায় সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমি নতুন বন্ধুদের বলতে চাই, সেকেন্ড রিপাবলিক…আমাদের বর্তমান রিপাবলিক কি অসুস্থ হয়ে গেছে?
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আরো বলেন ‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আপনাকে অতি শিগগির জাতীয় সংসদের নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রদান করতে হবে। যদি আপনি কোনো বাহানায় এই মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রদান না করেন, তাহলে সেটা আমরা রাজনৈতিকভাবে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো বসে নির্ধারণ করব আমরা কোন প্রক্রিয়ায় এগোব।’
বিএনপি নেতার এমন দাবি ও মন্তব্যকে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি এক ধরনের হুমকি হিসাবে দেখছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিএনএ নিউজ/ আরএস