বিএনএ, ঢাকা: ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গোলাম আযমের রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতে ইসলামীকে একটি অপরাধী সংগঠন হিসাবে অখ্যায়িত করে। ওই সময় রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দালিলিক প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, অধ্যাপক গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে ইচ্ছাকৃতভাবে অপরাধী সংগঠনের মতো কাজ করেছে, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া পাঁচটি রায়ের মধ্যে চারটিতেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে পাকিস্তানি সেনাদের ‘সহযোগী বাহিনী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধকালীন নৃশংসতার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের পাশাপাশি জামায়াতকেও দায়ী করেছেন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত দুটি ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত পাঁচটি রায় দিয়েছেন।
পাঁচটি রায় বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একমাত্র সাঈদী ছাড়া বাকি চারজনই মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াত বা এর তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। গোলাম আযম ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির; কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা ও আবুল কালাম আযাদ ছাত্র সংঘের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ জন্য এই চারজনের বিরুদ্ধে রায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।
২০১৩ সালের ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, উপমহাদেশের ইতিহাস বলে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দুটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার আন্দোলনের সময়ই জামায়াত বিতর্কিত ভূমিকায় ছিল। ওই সময় জামায়াত সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। এই দুই রাষ্ট্র গঠনে দলটির কোনো ভূমিকাই ছিল না। পাকিস্তান সৃষ্টির সময় জামায়াতের তৎকালীন আমির মাওলানা মওদুদী মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছিলেন।
কিন্তু মুসলমানরা আলাদা রাষ্ট্রের আন্দোলন শুরু করলে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হয়। ওই সময় জামায়াতে ইসলামী নিজেদের পাকিস্তানের একমাত্র ইসলামিক দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাবি করে। এর পরে যখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নিজেদের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু করে, তখনো জামায়াতে ইসলামী এর তীব্র বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সহায়তা করে। যখন ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছিল, তখনো জামায়াত নিজেদের প্রকৃত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল হিসেবে দাবি করে এবং যারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিল, তাদের ভারতীয় চর হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।
ট্রাইব্যুনাল তাঁদের পর্যবেক্ষণে আরও বলেছেন, বিভিন্ন নথি ও সাধারণ ধারণা থেকে দেখা যায়, অভিযুক্ত গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াত ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো প্রত্যক্ষভাবে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটি এখনো সক্রিয়। আর এর ফলে নতুন প্রজন্মের জামায়াত-সমর্থকেরাও মনস্তাত্ত্বিকভাবে স্বাধীনতাবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় পুষ্ট। এটা একটি জাতির জন্য উদ্বেগের বিষয়।
আমাদের জাতির কাছে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে একাত্তরে জামায়াত যে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা পালন করেছিল, তাদের সেই মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে এবং ৩০ লাখ শহীদের প্রতি সমবেদনা ও শ্রদ্ধার কোনো নিদর্শন তারা এখনো দেখায়নি। ট্রাইব্যুনাল পর্যবেক্ষণে বলেছে, একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বার্থে এ ধরনের স্বাধীনতাবিরোধীদের সরকারের কোনো নির্বাহী পদে, সামাজিক ও রাজনৈতিক দলে এবং সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনে কোথাও ঠাঁই দেওয়া উচিত নয়। লাখ লাখ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক একটি দেশ গড়ার ক্ষেত্রে এসব উচ্চ পদে এই স্বাধীনতাবিরোধীরা যাতে কোনোভাবেই আসীন না হতে পারে, সে জন্য রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এর আগে জামায়াতের নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে দেয়া রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বলেন, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর মস্তিষ্কপ্রসূত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধকালে ‘পাকিস্তান রক্ষা’র নামে বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি সেনাদের সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করে। জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয় আলবদর বাহিনী, যা ছিল প্রকৃতপক্ষে জামায়াতের ‘অ্যাকশন সেকশন’ বা ‘আর্মড উইং’।
কাদের মোল্লা ও আযাদের বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ে ট্রাইব্যুনাল-২ পর্যবেক্ষণ করেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল জামায়াতে ইসলামী, এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ ও আধা সামরিক বাহিনী আলবদর। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারাও নৃশংস অপরাধ ঘটায়। ওই দুটি রায়ে উঠে এসেছে, কীভাবে ছাত্র সংঘের সদস্য ও জামায়াতের প্রশিক্ষিত রুকনদের দিয়ে আলবদর নামের আধা সামরিক বাহিনীটি গড়ে তোলা হয়েছিল।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বাঙালি পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের নিশ্চিহ্ন করতে এবং বাঙালি রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রদের হত্যা ও গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। পাকিস্তান রক্ষার নামে জামায়াতে ইসলামী প্যারামিলিশিয়া বাহিনী বা সহযোগী বাহিনী গঠন করে নিরস্ত্র বাঙালি বেসামরিক ব্যক্তিদের নিশ্চিহ্ন করার অভিযানে অংশ নেয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই পর্যবেক্ষণের পর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ১১ বছর।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকগণ মনে করেন, আওয়ামী লীগ নানা রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে জামায়াত ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেনি। আইন আদালতের দোহাই ও কথার মারপ্যাচে জামায়াত ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি এড়িয়ে গেছে বার বার। অনেকটা দুধ কলা দিয়ে এতদিন কাল সাপ পুষেছে আওয়ামী লীগ সরকার। বৈষম্য বিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্রদের আবেগকে পুঁজি করে দুধ কলা দিয়ে পোষা সাপ ছোবল দিয়েছে। সারাদেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে পরিকল্পিত সন্ত্রাস ও নাশকতা চালিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছে।
অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের বৈঠকের পর সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াত ইসলামী এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধ হওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
বিএনএনিউজ/ শামীমা চৌধুরী শাম্মী/ বিএম/হাসনা